• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

পাল্লাহু । pAllahu

দাঁড়িপাল্লা ধমাধম-এর বাংলা ব্লগ

  • পাল্লাব্লগ
  • চুতরাপাতা
  • মহাউন্মাদ
  • ধর্মকারী
  • রেফারেন্স
  • ট্যাগস

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব – ৬)

You are here: Home / ধর্মকারী / সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব – ৬)
October 4, 2016
লিখেছেন উজান কৌরাগ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫
আজ শুক্রবার, ক্লাস না থাকায় একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙলো। মশারিটা খুলে বিছানা গুছিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে বাথরুমে ঢুকলাম। আমার বাথরুমটা অ্যাটাচড হওয়ায় বেশ সুবিধা হয়েছে, ঘনঘন সবার সামনে পড়তে হয় না। বাথরুম থেকে বের হতেই বাবার রাগী কন্ঠস্বর কানে এলো। রাগটা কি আমার ওপর! আমার এই হয়েছে এক সমস্যা, আজকাল বাসায় কেউ একটু রেগে জোরে কথা বললে প্রথমেই আমার মনে হয় যে, আমাকে নিয়ে কিছু বলছে! আমি বন্ধ দরজার কাছে এগিয়ে কান পাতলাম, না, কথাগুলো আমার উদ্দেশে নয়; সরকার আর অসাধু ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে। কথাবার্তায় বুঝতে পারছি, বাবা বাজারে গিয়েছিলেন আর দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া গতি দেখে চটে গেছেন সরকার আর ব্যবসায়ীদের ওপর। এটা নতুন কিছু নয়, পুরনো চিত্র। প্রত্যেক বছর রোজা এলেই ব্যবসায়ীরা চাহিদার তুলনায় যোগানের স্বল্পতার কথা ব’লে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সরকারের মন্ত্রীরা সিংহের মতো হুঙ্কার ছেড়ে বলেন, ‘পণ্যদ্রব্যের কোনো ঘাটতি নেই। দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 
এই কথাটা এখন কৌতুকের পর্যায়ে চ’লে গেছে। বছর বছর সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী এই একই রেকর্ড বাজান, কিন্তু যথারীতি বাজার থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে! 
বাবা বলছেন, ‘গেল সপ্তায় ত্রিশ টাকা কেজি শসা কিনলাম, সেই একই শসা আজ কিনতে হলো একশো কুড়ি টাকা দিয়ে! চিনি ছিল আটচল্লিশ টাকা কেজি, আজকে আনলাম পঁয়ষট্টি টাকায়। বেগুন তো আগুন! এমন কোনো একটা জিনিস নাই বাজারে, যার দাম বাড়ে নাই। হারাম রোজগার করতে এদের বিবেকে একটুও বাধে না, ইবলিশের দল সব!’
আমি কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাবার সংক্ষুব্ধ কথাগুলো শুনলাম, তারপর হাতের গামছাটা রেখে দরজা খুলে বের হলাম। বাবা বাজার থেকে ফিরে ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে আছেন আর মা রান্নাঘরের প্রবেশপথে বসে ব্যাগের ভেতর থেকে একে একে বের করছেন অতি মূল্যে কেনা দ্রব্যসামগ্রী। বাবার গায়ে একটা সাদা-কালো চেক শার্ট, পরনে প্যান্ট; মাথায় বোধহয় টুপি ছিল, টুপিটা এখন টেবিলের ওপর। আমি বাবার মুখাবয়ব লক্ষ্য করলাম ভালমতো, কপাল আর দাড়ির ওপরের অনাবৃত চোয়াল ঘামে স্যাঁতসেতে এবং লাল হ’য়ে আছে। সত্যিকারের রাগ হ’লে তার মুখ এমন রক্তাভ হয়। আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় ব’সে পত্রিকা হাতে নিলাম, সংবাদ শিরোনামেও আজ ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্য। আমি খবরটা পড়তে শুরু করলাম। পাতা উল্টে দ্বিতীয় পাতার বাকি অংশও পড়লাম। অনেক বড় প্রতিবেদন। কাঁচামরিচ থেকে শুরু ক’রে গরুর মাংস, এহেন জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। সরকার গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ ক’রে দিয়েছে, তারপরও নির্ধারিত দামের চেয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। সরকার কর্তৃক দাম নির্ধারিত পণ্যেরই যখন এই অবস্থা, তখন অন্যান্য পণ্যের দাম যে আরো লাগামছাড়া হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র ক’রে এমন অনৈতিক বাণিজ্য পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয় কি না, আমি জানি না। অবশ্য সারাবছরই অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছে মতো দ্রব্যমূল্য বাড়ায়-কমায়। আমি সেই বাল্যকাল থেকেই নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে মানুষের অভিযোগ শুনে আসছি। বরাবরই বাজারের ওপর কোনো সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। চাহিদার চেয়ে অধিক পণ্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ক’রে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নীরব; কেননা এই রমজানকে কেন্দ্র ক’রে মজুদদার-ব্যবসায়ীরা যে বাড়তি মুনাফা অর্জন করে, তার একটা অংশ যায় সরকারের ধার্মিক কর্তাব্যক্তিদের পকেটে। এই যে অসাধু ব্যবসায়ী এবং সরকারের কর্তাব্যক্তি, উভয় শ্রেণীর অধিকাংশের কপালেই কিন্তু নামাজ পড়ার সহি দাগ বিদ্যমান!
সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের বাজার বিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়তে পড়তে আমার হঠাৎ মনে পড়লো সুলতানি আমলের শাসক আলাউদ্দিন খলজীর কথা। ১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভারতে মুসলিম শাসকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরম্পরা অনুযায়ী তিনিও ছিলেন নিষ্ঠুর, নৃশংস, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক, সাম্রাজ্যলোভী। তার পিতার মৃত্যুর পর পিতৃব্য সুলতান জালালউদ্দিনের স্নেহ-ভালবাসায় বেড়ে উঠলেও সাম্রাজ্যলোভী আলাউদ্দিন সেই পিতৃব্যকে হত্যা করেই ১২৯৬ সালে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। একের পর এক রাজ্য আক্রমণ এবং নগর ধ্বংস ক’রে নিজের সাম্রাজ্য বাড়িয়েছেন। তবে বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে তিনি তার পূর্বাপর অন্যান্য শাসকের চেয়ে ব্যতিক্রম এবং কৌশলী শাসক হিসেবে পরিচিত, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ হলো তার বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। প্রচণ্ড স্বৈরশাসক হওয়া সত্ত্বেও প্রজাসাধারণ তার শাসনে অনেকটাই সন্তুষ্ট ছিল এজন্য যে, তিনি কঠোরভাবে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। চার ধরনের বাজার প্রতিষ্ঠা ক’রে তিনি সকল প্রকার পণ্যের বাজারদর নির্ধারণ ক’রে দিয়েছিলেন। বাজার চারটি হলো – ১. মান্ডি বা শস্যবাজার; শস্যবাজারে বিক্রয় হতো চাল, ডাল, গম ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য; সরকারী নির্দেশনা ঠিক মতো কার্যকর হচ্ছে কি না, তা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল শাহনা-ই-মান্ডি’র ওপর। ২. সেরা-ই আদল; এই বাজারে বিক্রয় করা হতো বস্ত্র, জ্বালানি তেল, চিনি, ফল, ওষুধ ইত্যাদি; এই বাজার পরিচালনা করতো সরকারি দপ্তর দেওয়ান-ই-রিয়াসৎ। ৩. অশ্ব, গবাদিপশু, ক্রীতদাসের বাজার; বয়স এবং গুণগত মানের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করা হতো। ৪. সাধারণ বাজার; এই বাজারে মাছ, মাংস, সব্জি, মনোহারী দ্রব্যাদি বিক্রয় করা হতো। সরকারের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক কঠোর হাতে এই বাজারগুলি নিয়ন্ত্রণ করতো। কোনো ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক দামে বিক্রয় করলে বা ওজনে কম দিলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এছাড়া কৃষকদের কাছ থেকে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত রাজস্ব আদায় করা হতো শস্যের মাধ্যমে। সমস্ত শস্য সংরক্ষণ করা হতো দিল্লির বিভিন্ন গোলাঘরে। দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়তো না। বিপর্যয় দেখা দিলে দুঃস্থ পরিবারের মধ্যে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পণ্যদ্রব্য বন্টন করা হতো। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সস্তা হওয়ায় এবং তা দীর্ঘকাল স্থিতিশীল থাকায় সেনাবাহিনীর শক্তি-দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছিল, ফলে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ করা সহজ হয়েছিল; জীবনযাত্রা নির্বাহে প্রজাবর্গ স্বস্তি লাভ করেছিল। রাজনৈতিক দূরদর্শী আলাউদ্দিন এই কঠিন কাজটি করতে পেরেছিলেন তার ইচ্ছা এবং কঠোর মনোভাবের কারণে। কেননা তিনি হয়তো বুঝেছিলেন যে, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সেনাবাহিনী এবং প্রজাবর্গের জীবনযাত্রার মান, সুখ-শান্তি; ফলে সেনাকে শক্তিশালী এবং প্রজাকে শান্ত রাখতে পারলে তার রাষ্ট্রপরিচালনা অনেকটাই সহজতর হবে, তেমনি জনগণের দুঃখকষ্টও অনেকটা লাঘব হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সুফলতার কথা স্বীকার ক’রে ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুল আলাউদ্দিনকে দুঃসাহসী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ব’লে অভিহিত করেছেন। মধ্যযুগের একজন স্বৈরশাসক দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবতে পারলেও এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে বিষয়টি ভীষণভাবে উপেক্ষিত! 
একালের রাজনীতিকরা ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন, অজ্ঞ, ইতিহাস সম্পর্কে জানে না; যতটুকু জানে, তা থেকে ভাল কিছু শেখে না, শেখে কেবল হিংস্রতা, দমন-পীড়ন। আর এখন তো আমাদের হৃদয়ের সংকীর্ণতা সংকুচিত করেছে ইতিহাসকেও। বর্তমান থেকে পেছন দিকে এগোলে কয়েকটি কমা’র পর ৭১ এ যতিচি‎হ্ন; এরপর আবার কয়েকটি কমার পর ৫২ তে দাঁড়ি। চূড়ান্ত সমাপ্তি টানা হয়েছে এখানেই, কি রাজনীতিকের বক্তৃতা-টকশোতে, কি বৃদ্ধিজীবীদের স্মৃতিচারণায়, কি সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন; সকলের ইতিহাস চর্চাই তরতর ক’রে এগিয়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে ৫২ তে। যেনবা বাংলাদেশের মানব ইতিহাসের শুরু বায়ান্নতেই, তার আগে আমাদের আর কোনো ইতিহাস নেই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের নামও উচ্চারিত হয় না কোথাও। তারও আগে আমাদের যে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস; তার চর্চা কেবল ইতিহাসের ছাত্ররাই হয়তো করে, তারপর তারাও ভুলে যায় পাশ ক’রে বেরোনোর পর! আর দেশের মানুষের একটা বড় অংশ তো বায়ান্ন এবং একাত্তরের ইতিহাসকেই স্বীকার করে না। যাদের একটু ভাসা ভাসা ধারণা আছে, মোগল এবং সুলতানি আমল বাদে বাকি ইতিহাসকে তারা ভাবে হিন্দুদের ইতিহাস, ও আমাদের জানার বিষয় নয়! ইতিহাস বিস্মৃত, ঐতিহ্য বিস্মৃত, সংস্কৃতি বিস্মৃত উন্মূল এক জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা; উদ্ভ্রান্ত, দিকভ্রান্ত, বিপথগামী এক জাতি! 
আমি ড্রয়িংরুমে এসে বসার পর বাবা আর কিছু বলছেন না। না বলার কারণ, আমি যদি বলি – দেখ, ধর্মকে পুঁজি ক’রে ধার্মিকেরাই এই ব্যবসা করছে, কোনো নাস্তিক কিংবা ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়ায়নি; তাই বাবা এখন চুপ। তবে বাবার এই সংক্ষুব্ধ মুখাবয়ব আমার বেশ ভাল লাগলো। 
আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি খাওয়ার জন্য ডাইনিং গিয়ে চেয়ারে বসতেই বাবা উঠে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেন। রোজার মাসে আমার জন্য পাউরুটি আর জেলি এনে রাখে, আমি নিজের মতো নিয়ে খাই। দুপুরের ভাতটা নিজেই ফুটিয়ে, ফ্রিজের তরকারি গরম ক’রে খাই। আর ক্যাম্পাসে গেলে বা অন্য কোনো কাজে বাইরে থাকলে হোটেল খেয়ে বাসায় ফিরি। যদিও রোজার মাসে বেশিরভাগ হোটেলেই দিনের বেলা খাবার পাওয়া যায় না। 
চার বছর পূর্বে রোজার আগের রাতে আমি যখন মাকে জানালাম আমাকে সেহেরী খেতে ডেকো না, আমি রোজা রাখবো না, তারপর কারণ জিজ্ঞাসা করায় যখন আমি জানালাম যে আমি তোমাদের কাল্পনিক আল্লাহ আর তার রীতিনীতিতে বিশ্বাস করি না; তখন বাড়িটা শুধু কারবালা হতে বাকি ছিল আরকি! বাবা-মা, বড় আপা আর দাদী শুরুতে আমার কথা শুনে আঁতকে উঠেছিলেন এই ভেবে যে, মুসলমানের ছেলের মুখে এসব কী কথা! তারপর তারা আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন, তখন তারা ধমকি-ধামকি ক’রে চিৎকার করতে শুরু করলেন। আমিও আমার জায়গায় অনড়। আমাদের উচ্চকন্ঠ শুনে দোতলা থেকে সপরিবারে চাচা, চরতলা থেকে সপরিবারে ফুফু হাজির। চাচা তো শুনেই আগুন! তাদের মিষ্টি কথা, টক-ঝাল কথা, অগ্নিবাক্যেও যখন কোনো কাজ হলো না, তখন এক পর্যায়ে চাচা ক্ষেপে গিয়ে আমাকে কিল-চড় মারতে লাগলেন, আমার ফুফা মার ঠেকানোর জন্য এগোতে গিয়েও কেন যেন দাঁড়িয়ে পড়লেন, হয়তো ফুফুর চোখের ইশারায়। আমার ফুফুর চোখের আগুনকে ফুফা ভীষণ ভয় পান! মা গিয়ে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে পা ছড়িয়ে এমনভাবে কাঁদতে লাগলেন, যেন তার পুত্রবিয়োগ ঘটেছে! যখন বুঝলাম, কেউই আমাকে রক্ষা করবে না, নিজেই নিজেকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে তড়িৎ বেগে চড় মারতে উদ্যত চাচার হাত ধরলাম, ‘আপনার আল্লাহ বলেছে, সীমা লঙ্ঘনকারীকে সে পছন্দ করে না, আমিও সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করি না। ধর্ম পালন করা বা না করা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত জায়গায় নাক গলাবেন না। আর সবাইকে আপনার অনুগত ভেবে গায়ে হাত তোলা কিংবা ধমকানো আপনার স্বভাব, নিজের সম্মান বজায় রাখতে চাইলে আমার ক্ষেত্রে এই স্বভাবটা আজ থেকে ত্যাগ করবেন।’
তাৎক্ষণিক এই শক্তি আমি কীভাবে সঞ্চয় করেছিলাম, জানি না, জীবনে বাবা-চাচার মুখের ওপর কথা বলিনি, সেই প্রথম। বিশ বছরের টগবগে রক্তের উত্তাপে কথাগুলো ব’লে ফেলে আমি নিজেই অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমিও এভাবে প্রতিবাদ করতে পারি! আর অন্যরা তো রীতিমতো স্তম্ভিত-স্তব্ধ, তারাও বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে, আমি চাচার সামনে এই ভাষায় কথা বলতে পারি! সেই স্তব্ধতা ছিল কয়েক মুহূর্তের। তারপরই আমার দাদি তেড়ে উঠেছিলেন, ‘কী কইলি তুই! কী করতে চাস তুই, মারবি আমার পোলারে? মার, মার, মার না দেহি তোর কতো ক্ষ্যামতা! ঘাড় ধইরা রাস্তায় বাইর কইরা দিমু।’ 
আমার বিশ বছরের গরম রক্ত আবার ছিটকে বের হলো, ‘তুমি তোমার বাপের বাড়ি থেইকা বাড়ি নিয়া আইছিলা মনে অয়, এইটা আমার দাদার বাড়ি; বাড়ির গরম আমারে দ্যাহায়ো না।’ 
এরপর দাদি কেঁদে-কেটে কী না কী বলতে শুরু করলেন আর আমার বাবা আমাকে শাসন করা কর্তব্যজ্ঞান মনে ক’রে আমাকে বেধড়ক পেটালেন। এক পর্যায়ে আমার ফুফা ফুফুর গরম চক্ষু উপেক্ষা ক’রে বাবাকে থামালেন। 
অমন ধুন্দুমার কাণ্ডের পরও ভোরবেলায় আমাকে সেহেরী খেতে ডেকেছিল, কিন্তু আমি উঠিনি। বাবা আমাকে অনেকবার ডাকার পরও আমি যখন ভেতর থেকে সাড়া দিলাম না, তখন দুম ক’রে কয়েকটা শব্দ হলো দরজায়; বুঝলাম, বাবা রেগে দরজায় লাথি মারলেন। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর রোজকার মতো ড্রয়িংরুমে ব’সে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, মা নিশ্চয় আমাকে কিছু খেতে দেবেন। খুটিয়ে খুটিয়ে খবরের কাগজ পড়লাম দীর্ঘক্ষণ, কিন্তু মা আমাকে খেতে বললেন না। কী একটা কাজে মা যখন ডাইনিং-এ এলেন, তখন ইচ্ছে করেই মাকে দেখিয়ে ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক ক’রে পান করলাম। আড়চোখে দেখলাম যে, মা একবার আমার দিতে তাকিয়ে নিজের ঘরে চ’লে গেলেন। বড় আপাও আমার পানি পান করা দেখলো। এরপর আমি নিজের ঘরে ফিরে এসে ব’সে রইলাম। আমার ভেতরে আশা যে, আমাকে পানিপান করতে দেখার পর মা নিশ্চয় কিছু খেতে দেবেন, নিশ্চয় আমার জন্য ভাত রান্না করবেন। কিন্তু আমার ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত ক’রে আমাকে কিছু খেতে দিলেন না মা, দুপুরে আমার জন্য ভাতও রান্না করলেন না। প্রত্যেক বছর রোজার সময় যেমন থাকে বাড়ির পরিবেশ, তেমনই রইলো। 
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, আমি পেটে ক্ষিধে নিয়ে শুয়ে-ব’সে, বই প’ড়ে-গান শুনে সময় পার করছি। বাবা সেদিন অফিসে না গিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। দুপুরের আগে বাবা ফাহাদকে সঙ্গে নিয়ে চকবাজারে গেলেন ইফতার কিনতে। প্রতিবছর রোজার প্রথম দিনটায় চকবাজার থেকে বাহারি ইফতার কিনে আনা হয়; এটা আমাদের পরিবারের রেওয়াজ হ’য়ে গেছে। ক্লাস ফোর-ফাইভে ওঠার পর থেকেই ইফতারি কিনতে বাবার সঙ্গে আমিও যেতাম। বাপ-বেটায় ঘুরে ঘুরে একেকবার একেক রকম ইফতারি কিনতাম। তবে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ কিনতাম প্রত্যেক বছরই। 
‘বড় বাপের পোলায় খায়
ঠোঙায় ভইরা লইয়া যায়
ধনী-গরিব সবাই খায়
মজা পাইয়া লইয়া যায়।’
এই ছড়া বলতে বলতে বিক্রেতারা ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বিক্রি করে। বাবা আমাকে বলতেন, ‘তোর কী কী পছন্দ?’ ছেলেবেলায় বিভিন্ন রকমের অতো খাবার দেখে আমার তো ধাঁধা লেগে যেতো চোখে। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলবো! কতো যে বাহারি নাম – ‘বড় বাপের পোলায় খায়, শাহী পরোটা, শাহী জিলাপি, খাসির রান, আস্ত মুরগী ফ্রাই, কোয়েল পাখি, চিকেন শাশলিক, সুতি কাবাব, রেশমি কাবাব, টিক্কা কাবাব, কিমা, হালিম, দইবড়া, হালুয়া, জর্দা, লাবাং, বোরহানি, ফালুদা, আরো যে কতো নাম! খাসির ইয়া বড় রান দেখে বাবাকে প্রশ্ন করতাম, ‘আব্বা, এতোবড় খাসির পা কিসে রান্না করে?’ বাবাকে তখন আমি আব্বা ব’লে ডাকতাম।
বাবা বলতেন, ‘বড় হাঁড়িতে রান্না করে।’
আমি মনে মনে হাঁড়ির একটা মাপ কল্পনা করতাম। ছোট মাথায় বড় হাঁড়ির আকৃতিটা ধারণ করার পর এতো এতো খাবারে চোখ বুলাতাম আর ভাবতাম, আচ্ছা এতো খাবার মানুষ খেতে পারে! তারপর পছন্দ মতো খাবার কিনে বাপ-বেটা সিএনজি নিয়ে চ’লে আসতাম বাড়িতে। 
অনেক বছর বাদে আমাদের অভ্যস্ততায় পরিবর্তন ঘটলো, আমি স্বেচ্ছা গৃহবন্দী হ’য়ে থাকলাম আর ফাহাদ বাবার সঙ্গে ইফতার কিনতে চকবাজার গেল। এদিকে খিদেয় আমার কাহিল দশা। ধুন্দুমার কাণ্ডের পর আগের রাতে না খেয়েই ঘুমিয়েছি। পকেট হাতড়ে দেখলাম, তেইশ টাকা আছে। আমার কাছে কখনোই বেশি টাকা থাকে না। টাকার প্রয়োজন হলে চাইলেই পাই, তাই টাকা জমিয়ে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। টাকা জমানোর স্বভাবও আমার নয়। এই তেইশ টাকা দিয়ে আমি কী খাব? এ দিয়ে তো চা-বিস্কুটের বেশি কিছু হবে না; অথচ পেটে ভাতের ক্ষিধে! রোদ একটু ম’রে এলে বাইরে যাবার জন্য জামা-প্যান্ট প’রে দরজা খুলে ডাইনিংয়ে যেতেই কিচেনে কর্মরত মা বললেন, ‘যাস কই?’
‘কাজ আছে।’ 
‘এখন বাইরে যাবি না। তোর আব্বা চকে গেছে ইফতার কিনতে, সবার সাথে ব’সে ইফতার করবি।’ 
‘আমি রোজা না, পানি খাইছি।’
‘তাও সবার সাথে ইফতার করবি।’ 
দরজা খুলতে খুলতে বললাম, ‘দেখি, কাজ হইলে ফিরবো।’
আমি দরজা খুলে স্যান্ডেল পায়ে দেবার সময় মা বললেন, ‘খুব বাড়াবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে কিন্তু, এখন বাইরে যাবি না।’
(চলবে)
Category: ধর্মকারীTag: রচনা
Previous Post: « বেদ্বীনবাণী – ৭৪
Next Post: ধর্মর্ষকামীরা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পাল্লাহু । pAllahu • ফেসবুক • পেজ • টুইটার

Return to top