তসলিমা নাসরিন সমীপে খোলা চিঠি
অনেককাল আগে কোনো এক বইয়ের ফ্ল্যাপে ছবি দেখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। দৃষ্টিতে এত্তগুলা মুগ্ধতা ছিল। সেটা দেখেই মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, পছন্দ হয়?
কী উত্তর দেবো, ভেবে না পেয়ে একবার মায়ের দিকে চোখ তুলে আবার ছবিটার মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম।
মা আবার হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিয়ে করবি?
তখন ছেলেমানুষী করে উত্তর দিয়েছিলাম, হুম!
–কিন্তু তা তো আর হবে না!
–কেন?
–বিয়ে করে ফেলেছে যে!
–কাকে?
–করেছে, এক মোল্লাকে!
মোল্লার রহস্যটা পরে বুঝেছিলাম–কবির মুখভর্তি দাড়ি ছিল বলে মজা করে মোল্লা বলেছিলেন।
মোল্লাকে হিংসা করেছি অনেকদিন পর্যন্ত। পরে যতবার ‘মোল্লা’র ছবি দেখেছি, ততবার সেই পুরানো কথা মনে করে হেসে ফেলেছি। তবে আপনার প্রতি মুগ্ধতা কোনোদিন কাটে নি। এমনকি কারো চেহারায় আপনার বিন্দুমাত্র ছাপ থাকলেও বর্তমান যুগের মতো ‘ক্রাশ’ খেয়েছি।
তারপর আপনার নামে-বেনামে সত্য-মিথ্যা সংযোগে কত কথা শুনেছি। কারো কাছে দেবীতুল্য, কারো কাছে ডাইনী! আর নিজের কাছে মনে হতো–ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বলা যায় না কথা…
মনে আছে পুরানো আইডিটা একেবারে ব্যান হয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগেও অনেকে আমার প্রতি বিরক্ত হয়েছে–কেন রুট লেভেলের নতুন পোলাপানদের কমেন্টের উত্তর দেই। তখন বলেছিলাম, ভার্চুয়ালের রথী-মহারথী নবী-মহানবীদের লেভেলে যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই বলেই রুট লেভেলে নতুনদের সাথে বাতচিত করতেই বেশি ভালো লাগে। আর এই লেভেলেই প্রশ্ন বেশি, সন্দেহ বেশি–এদের এদের সাথে মিশে এদের প্রশ্ন-সন্দেহের উত্তর খুঁজে দিতে সাহায্য করতে পারলেই আমার জন্য অনেক।
ফেসবুকে এসে আপনার নামের আগে-পরেও অনেকরে নবি-গুরু ইত্যাদি ট্যাগ যুক্ত করতে দেখেছি। প্রথম দিকে নতুন যারা আসত তাদের সাথে মহানবীকে নিয়ে কথা হতো। তারা মনে করত, মহানবি সকল ভুলের ঊর্ধ্বে। তাদেরকে পালটা প্রশ্ন করতাম–মহানবি কি মানুষ না কি ফেরেস্তা বা শয়তান? তারা বলত–নবিজি মানুষ। বলতাম, মানুষ মাত্রেই যদি ভুল হয়, তাহলে মহানবির কিছু ভুলের লিস্ট দেন। তারা ক্ষেপে যেত!
সাত দিনের ব্যান শেষে সবে এই আইডিতে ফিরেছি। এসে
দেখলাম, অনেকেই আপনার ভুল ধরছে–হাজার হাজার রিএকশন, পোস্ট, কমেন্ট, শেয়ার।
সম্বিৎ ফিরে পেলাম–আপনাকে মানুষ হিসাবেই তো দেখতে চেয়েছি। মানুষের সাথেই
মিশে যাবেন চেয়েছি। মানুষের জন্যেই লিখতে বলতে শুনতে চেয়েছি। আপনি সেটা
বলেনও। অন্যেদের চেয়ে অনেক বেশিই বলেন। আর যত বেশি বলবেন, তত বেশি ভুল
হবে–মানুষ তো!
কিন্তু ফেসবুকের রথী-মহারথী নবি-মহানবিরা ভুল করেন না।
কেউ তাদের সমালোচনা করলে আইডি থাকে না, তাদের নিয়ে কেউ ট্রল করলে পায়ের
তলার মাটি সরে যায়।
আধুনিক নবিরা কিছু বলা বা লেখার আগে কয়েকবার ভাবে–কে কী মনে করবে! লাইক-কমেন্ট পড়তে তো! কেউ আবার ছ্যাঁচা দেবে না তো! তারা লেখে পরের মন জুগিয়ে। তাদের লেখা জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু নিজের মনে যা আসে, প্রাণ খুলে সেটা বলার ক্ষমতা সবাই রাখে না।
একটা ব্যাপার মনে-প্রাণে মানি–আমি যদি আপনার সমালোচনা করি, এর অর্থ আপনি এখনো বেঁচে আছেন, আমিও বেঁচে আছি। যাদের সমালোচনা হয় না, যারা সমালোচনা করে না–তারা সবাই-ই মৃত! আপনার প্রচুর সমালোচনা (গালাগালি কেউ গোণায় ধরে না, অভিজ্ঞতা বলে, এরাও গালাগালি বাদ দিয়ে সমালোচনা করতে শিখবে) দেখে আমিও বুঝলাম আপনি আসলে নবি বা গুরু টাইপের কেউ নন। আপনি আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। আপনাকে ধরা যায়, আপনাকে ছোঁয়া যায়, আপনাকে বলা যায়…
যারা আপনাকে নবি-গুরু ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তারা হিংসা থেকে ওসব কুৎসা রটায়। আপনি সবসময় আলোচিত-সমালোচিত, সর্বোপরি আপনি জীবন্ত–এই ব্যাপারটাকে তারা হয়তো ভয়ও পায়। আপনি ভুল করুন, আরো বেশি বেশি ভুল করা মানুষ হয়ে উঠুন… আরো বেশি বেশি জীবন্ত হয়ে উঠুন… লাইক-কমেন্ট কমে যাওয়ার ভয়ে, জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ভয়ে, সামাজিক ভাবে বা ফ্রেন্ড সার্কেলে বয়কট হওয়ার ভয়ে, আপনার ‘পা চাটা কুত্তা’ ট্যাগ খাওয়ার ভয়ে অনেকেই আপনার পক্ষে কিছুই হয়তো বলবে না… আপনার পক্ষে কেউ না থাকুক, ‘ওয়ানম্যান আর্মি’র মতো আপনার একা একা চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধ জারি থাকুক…
–দাঁড়িপাল্লা (পা চাটা কুত্তা) ধমাধম
শহীদুজ্জামান সরকার
“আপনি ভুল করুন, আরো বেশি বেশি ভুল করা মানুষ হয়ে উঠুন… আরো বেশি বেশি জীবন্ত হয়ে উঠুন…”
ভুলই যদি না হবে তাহলে মানুষ তিনি কিভাবে?
শুভ্র বসু
অসাধারণ ….. আহা বাংলাদেশ ….. আর ও যদি কিছু আপনাদের মতো হতো !!!!