ছবিটা খুব সম্ভবত ন্যাড়া পোড়ানোর, তবে কেউ হয়তো মজা করে বা সত্যি সত্যিই করোনা ভাইরাসের নাম লিখে দিয়েছে। ব্যাপারটা অমূলক বা অবিশ্বাস্য নয়। এরকম ঘটনা আগেও হইছে…
যখন এই ধরনের নতুন কিছু দেখি, তখন আর অবাক হই না। এর আড়ালে এদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করি। তো এই ছবিটা দেখে আমার শনি, শীতলা, ওলাবিবি–প্রভৃতির কথা মনে পড়ছিল।
একটা সময়ে, হয়তো এখনো কোথাও কোথাও, যখন কোনো পরিবারে একের পর এক খারাপ ঘটনা ঘটতে শুরু করে তখন সবাই বলে–তোদের পিছনে শনি লাগছে, শনি পূজা কর…
তারপর কোনো এক শনিবারে আয়োজন হয় শনি পূজা। মানে শনি তাড়ানোর পূজা–শনিরে পূজা কইরা মানে হাতে-পায়ে ধইরা তুষ্ট কইরা বলা যে–আপনে এবার দয়া কইরা দূরে কোথাও ভাগেন…
শনি পূজা ঘরে করে না, ঘরের বাইরে করা হয়। এমনকি এর প্রসাদ থেকে শুরু করে কোনো কিছুই ঘরে নেয়া হয় না। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা…
তারপর ধরেন শীতলা দেবী আর ওলাবিবির পূজা। শীতলা হইলো বসন্ত রোগের দেবী, আর ওলাবিবি হইলো কলেরা রোগের দেবী। এইসময়ে এই ধরনের রোগে গ্রামের পর গ্রাম শূন্য হইয়া যাইত। সে কারণে এই শনির মতো এই দুইটা রোগরেও তাড়ানোর জন্য গ্রামাঞ্চলে এইসব পূজা হইত।
এই দুইটা পূজা প্রায় একসাথেই পাশাপাশি করা হইত–বাড়ির বাইরে তো বটেই, একেবারের বাড়ির সীমানার বাইরে, যাতে ওখান থেকেই এরা বিদায় নেয়।
দুইটা পূজাই প্রায় একই রকম ভাবে করা হইত। বাংলাপিডিয়া থেকে একটু অংশ তুইলা দিতেছি–//ওলাদেবীর পূজায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে একই পুরোহিতের হাতে পূজার নৈবেদ্য ও মানতের দ্রব্য প্রদান করে। পুরোহিত নিম্নবর্ণের হিন্দু কিংবা মুসলমান হলেও কেউ তাঁর নিকট থেকে নৈবেদ্য গ্রহণে দ্বিধা করে না। ওলাদেবীর নৈবেদ্য অতি সাধারণ সন্দেশ, বাতাসা ও পান-সুপারি; কোথাও কোথাও আতপ চাল ও পাটালিও দেওয়া হয়। এ পূজায় বিশেষ কোনো মন্ত্র নেই; তবে কোনো কোনো হিন্দু পুরোহিত পূজার সময় ‘এসো মা ওলাদেবী, বেহুল রাঢ়ির ঝি’ এরূপ আবেদন করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লীতে একসময় খুব গুরুত্বের সঙ্গে ওলাদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভাবে সমাজ থেকে এসব আচার এক প্রকার উঠে গেছে বলা যায়।//
শেষের লাইনটাই আসল কথা–আধুনিক শিক্ষা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভাবে সেসব রোগবালাই এখন আর তেমন হয় না, তাই এসব দেবদেবীর পূজাও খুব একটা দেখা যায় না।
মানুষ একসময়ে করোনাকেও বিদায় করবে, তখন এই ধরনের পূজাও আর করা লাগবে না। এর পিছনে আরেকটা গূঢ় সত্য কথা লুকানো আছে–আস্তিক বা বিশ্বাসী বা ‘অশিক্ষিত’ মানুষেরা সেটা সহজে স্বীকার করবে না–তারা যখন বিপদে পড়ে, অজ্ঞতার বশে যখন শিক্ষা ও বিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখতে পারে না, তখনই ধর্মের মতো এ ধরনের কুসংস্কারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
আর দেখা যাচ্ছে, এককালে মুসলমানরাও হিন্দুদের মতো এ ধরনের পূজা করত। ইদানিং তারা হুজুর আর ওয়াজের প্রভাবে সেটা করছে না ঠিকই, তবে তারাও অন্য ভাবে–দোয়া-দরুদ, ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া–ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ধর্মের দিক দিয়া আচরণগত পার্থক্য থাকলেও এদের সবার মন-মানসিকতা এক।
Leave a Reply