শুধুমাত্র পাঠ্যবই নিয়া বসলেই ঘুম পাইত। নয়তো রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। তবে ঘুমের ‘ওষুধ’ ছিল–বাড়ির বড়রা যদি বলত–আয় মাথা হাতাইয়া দেই… কোলের ওপর শুয়ে চোখ বুজতাম, তারপর কইতাম–একটা গল্প কও। শুরু করে দিত–ভূত-রাক্ষস-খোক্কস-রূপকথার গল্প থেকে শুরু করে নানান কিসিমের গল্প। আবার একই গল্প মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে আসত। তেমনই একটা গল্প–গুয়ের ন্যাড়ের গল্প। কতবার যে শুনেছি! চুলে বিলি কেটে দেয়া আর পিঠ চুলকে দেয়ার আরামে-ঘুমের ঘোরে থাকতাম বলে বাধা না দিয়ে মাঝে মধ্যে শুধু হু-হু করতাম…
২) যারা ছোটোবেলা ‘বাংলাদেশের বন্যা’ রচনা মুখস্থ করেছেন, তারা বন্যার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে অবগত আছেন, এবং অনেকে দেখেছেনও।–নোংরা-আবর্জনা ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয় বন্যা… সেকালে গ্রামের দিকে প্রায় সবই ছিল খোলা। রিং বসানো বা পাকা যদি দু-একটা থাকত, তারাও বন্যার সময় ঢাকনা খুলে দিত। অনেকে আবার বাঁশ দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দিত, যাতে সর্বোচ্চ মাত্রায় ময়লা বের করে দেয়া যায়।
ওদিকে যেগুলো খোলা, সেগুলোও প্রায় বন্যার পানিতে ডুবে যেত। তখন কলাগাছের ভেলা বা নৌকা নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি ধানক্ষেত পাটক্ষেত ধইঞ্চাক্ষেতের দিকে দৌড়াতে হত। এদিকে বাড়িতে লাইন লেগে গেছে–ধরেন আপনে ক্ষেত বা ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে সবে বসছেন, আর তক্ষুনি বাড়ি থেকে হাঁক–এই নৌকা নিয়া আয় তাড়াতাড়ি… [হাগু বাইরে পড়লেও, প্রস্রাব কিন্তু নৌকার ভেতরেই…]
পানি যতদিন বাড়ছে কিন্তু নামছে না, ততদিন মোটামুটি সব ঠিক আছে। কিন্তু যেই পানি দক্ষিণে নামতে শুরু করবে, তখন আপনার বাড়ির উত্তরে যারা হাগু করছে–পাতলা গু হলে ধরেন পানিতে মিশে গেলো, কিন্তু যদি শক্ত ন্যাড় হয়, তাহলে নিশ্চিত সেগুলার ভাগ আপনি পাবেন–আপনার বাড়ির উপর দিয়েই নামবে। আর যদি ঘরের ভেতরেই পানি ঢুকে যায়, তাহলেও গুয়ের ন্যাড় যাত্রাপথে আপনার ঘরের মধ্যেও মাঝেমধ্যে বিশ্রামের জন্য চলে আসতে পারে। ধারণা করি, সেকালে এসব দেখেই হয়তো কারো কারো মনে ‘গুয়ের ন্যাড়ের আত্মকথা’ জাতীয় গল্পের উদ্ভব হতো…
৩) সব বন্যায় ঘরে পানি না ঢুকলেও মাঝে মাঝে ঢুকত। ঘরের মধ্যে উঁচু করে বাঁশের মাঁচা–বড়রা তো নানান কাজে ভোরবেলাতেই বের হয়ে যেত, আর ছোটোদের ওই মাচার ওপরে শুয়ে-বসে কাটছে প্রায় সারাদিন। প্রস্রাব ওখানে বসেই, আর এক ঘর থেকে আরেকঘরে যাওয়ার জন্য উঠানের উপর দিয়ে যে বাঁশের সাঁকো–তার ওপরে বসে হাগু… এই উঠানেই আবার সাঁতার শেখা, লাফালাফি, ডুবাডুবি… একঘেঁয়েমি লাগলে ঘরের মধ্যেই বড়শি দিয়ে টেংরা-পুঁটি ধরার চেষ্টা… কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের মধ্যে গুয়ের ন্যাড় আবিষ্কার… পাটখড়ি দিয়ে ঠেলে ঠেলে সেগুলারে দরজা দিয়ে বাইরে বের করা…
[কেউ হয়তো একটু পরে খেতে যাবেন, বা খেয়ে আসছেন, বা খাচ্ছেন–তাই আর বিস্তারিত বর্ণনায় গেলাম না। গালাগালি দিয়ে এখানেই বিদায় হতে পারেন। অবশ্য বাকিটুকুতে আশা করি এরকম কিছু আসবে না…]
৪) তারপর গ্রাম থেকে শহরে ছোটা। তখন এতো ব্রিজট্রিজ ছিল না। যাত্রাপথে প্রায়ই লঞ্চ-ফেরি পারাপারের দ্বারস্থ হতে হতো। লঞ্চের একেবারে পেছন দিকে পাশাপাশি দুইটা রুম। একটা খুব সম্ভবত রান্নাঘর বা ‘স্টোররুম’, আরেকটা টয়লেট। এই দুয়ের ছাদের উপরে নামাজের ব্যবস্থা। আটআনা-এক টাকার ঝালমুড়ি, আর সিদ্ধডিম পাওয়া যেত দুই টাকায়। (সেই ঝালমুড়ি–খেতে খেতে অর্ধেক বাতাসে উড়ে যেত–সেই স্বাদ জীবনে আর কোনো জায়গার ঝালমুড়িতে পাওয়া গেলো না!)
খেয়েদেয়ে বাড়ি থেকে বের হতাম। পথেও হাবিজাবি খাওয়া লাগতো। আর দীর্ঘ বাসভ্রমণ শেষে লঞ্চ-ফেরিতে উঠেই সবাই লাইন লাগিয়ে দিত ওই টয়লেটে। [বাসে বসেই নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আল্লাবিল্লা করতাম–তখন লঞ্চে উঠতে পারব! একবার তো প্রায় প্যান্টই নষ্ট করে ফেলছিলাম–আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছিলাম যতদিন না লং জার্নির বাসে টয়লেট হবে, ততদিন এই *লের জার্নিই বাদ!] লঞ্চের টয়লেটের পেছনে আরো একটু জায়গা থাকত। দড়ি বা শিকলে বাঁধা থাকত দু-একটা ছোট বালতি। ওটা দিয়ে পানি তুলে বদনা ভরে ভেতরে ঢুকে যাওয়া। অপেক্ষারত অবস্থায় দেখতাম–টয়লেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ওই বালতি দিয়ে পানি তুলে অবলীলায় গোসল সেরে নিচ্ছে লঞ্চের কর্মীরা। এই পানি দিয়েই কি রান্না হতো লঞ্চের সেই বিখ্যাত সর্ষে-কাঁচামরিচ দিয়ে ইলিশ মাছের পাতলা ঝোল আর গরম গরম ভাত!
৫) গাড়িতে উঠলে বমি হয় বলে নৌকাভ্রমণটাই সবচেয়ে বেশি প্রিয়। বর্তমানে নৌকা বা লঞ্চ-ট্রলারে করে হাওরে বেড়াতে যাওয়ার একটা ‘ট্রেন্ড’ শুরু হয়েছে। অনেকেই তাদেরে বেড়ানোর ছবি দিচ্ছে। প্রচুর লোকে যাচ্ছে–সারিসারি লঞ্চ-ট্রলার ভেড়ানো। মনে হচ্ছে ওখানে বেড়াতে যেতে না পারলে আর জাতে ওঠা যাচ্ছে না। কিন্তু যে কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলেই আমার সবার আগে টয়লেট-সিস্টেমের ব্যবস্থা কেমন সেটা জানতে ইচ্ছে করে। [গোপাল ভাঁড় আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেই হাগু করার গল্পটা তো জানেন!] আবার পানিতেও নামতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু হাগু করার পরে গু যদি সরাসরি পানিতে গিয়ে পড়ে–মানে ধরেন সকালে উঠে হাগু করে তারপর পানিতে লাফিয়ে পড়লাম–ব্যাপারটা ভাবতেই তো কেমন যেন লাগছে! তারপর একটা জায়গায় অতগুলা লোকের হাগু–সবই যদি পানিতে গিয়ে মেশে… আর পানিতে নেমে যদি দেখি সেই পুরানো কালের মতো গুয়ের ন্যাড় নিজেদের দিকে ভেসে ভেসে আসছে… তারপর খাওয়ার পানিটা না হয় বোতলে করে নিয়ে গেলাম, কিন্তু ওখানে গিয়ে মুখ ধোয়া, রান্না করা, ধোয়ামোছা–ওসব হয় কোন পানি দিয়ে কে জানে!
কিছুদিন বিদেশে থেকে এখন দেশে এসে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে–ধূলোবালি, শব্দ, দুর্গন্ধ–এগুলো সহ্য হচ্ছে না; এলার্জি হচ্ছে; মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে; খাওয়ার পানি, খাবার-দাবার একটু এদিক-ওদিক হলেই পেট খারাপ হচ্ছে… তাই যদি যাই, আগে থেকে সবকিছু জেনেবুঝে, করোনাকে পাশ কাটিয়ে, তারপর একদিন যাওয়া যায় কি না দেখি…
[ভ্রমণসংক্রান্ত কোনো উপদেশ সতর্কতা সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি ‘টিপস এন্ড ট্রিকস’ দিয়ে বাধিত করতে পারেন।]
[ছবি : বিডিনিউজ২৪ ডট কম]
Leave a Reply