তুমি আমার মনের মানুষ মনেরই ভিতর/ তুমি আমার জান বন্ধু অন্তরের অন্তর… বোরখাওয়ালী শুনাইত এক সময়। এটা বোরখাওয়ালী আর আমার কয়েকটা জাতীয় সংগীতের মধ্যে একটা হয়ে গেছিল। অনেকদিন হয় বোরখাওয়ালীর সাথে অফিসিয়ালি কোনো সম্পর্ক নেই, তবে সেদিন ঘটনাক্রমে তার গাড়িতে চড়তে হয়েছিল, তখন গানটা গাড়িতে বাজছিল। দুজনেই হাসছিলাম।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা দুজনেই বুঝতাম–বিয়ে জিনিসটা ভালো জিনিস না। তবুও আমরা বিয়ে করেছিলাম। ব্লগ-ফেসবুকের প্রথম দিকে বিয়ের বিপক্ষে প্রচুর যুক্তি-তর্কেও অংশ নিয়েছি। বিয়ে ভালো জিনিস না–এটা আবার উপলব্ধি করেই মাঝপথে এসে আমাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেলো। বিয়ে ভালো জিনিস না–এটা মাথায় রেখেই আবার আমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বেল তলায় গেছি। বড় অদ্ভুদ আমাদের স্ববিরোধিতা…
এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ–দক্ষিণবঙ্গে বিশুদের প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আছে। সেই সুবাদে নানান অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ্যে বিশুর সাথে উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ করতে হয়েছে। আর যাওয়া-আসার এই পথটা লালন সাঁইয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে। এই পথে যাতায়াতের সুবাদে ছোটবেলা থেকেই লালন সম্পর্কে যেটুকু কথা হাওয়ায় ভাসে, মোটামুটি তার প্রায় সবটাই কানে আসছে, আর কানে বাজছে সাঁইয়ের গান–মিলন হবে কত দিনে/ আমার মনের মানুষের সনে…
পরে শুনেছি আজম খান, বুঝেছি–মন মেলে, মনের মানুষ মেলে না… বোরখাওয়ালীর সাথে মন মিলেছিল, কিন্তু পরে বুঝছি–মনের মানুষ শুধু মনেই থাকে… বাস্তবে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না…
এর মধ্যে খুঁজে পেলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ‘। উৎসর্গ পাতায় গৌতম ঘোষের নাম। হয়তো এই ঋণ শোধ করতেই গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নিয়ে সিনেমা বানাতে বসে যান। যেখানে ‘এক এবং কয়েকজন’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ টাইপের ঢাউস সাইজের বই পড়ার অভ্যাস, বা এসব বইতে সুনীল যেভাবে সময়কে ধারণ করেছেন, সেখানে এতো ছোট একটা বইতে কীভাবে লালনকে ধারণ করবেন–এসব ভেবেই বই আর সিনেমা–কোনোটাই এতোদিন পড়া বা দেখা হয় নি।
আমেরিকাতে আসার পরে এসব বই আরো দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেলো। আর পিডিএফ পড়তে গেলে চোখে সমস্যা হয় খুব। তবুও কয়েকদিন আগে কী মনে করে যেন পড়ে অনলাইনে পড়ে ফেললাম। সিনেমাটাও দেখে ফেললাম। বইটি পড়তে গিয়ে নতুন তেমন কিছু পাই নি। সুনীল নিজেও বইয়ের শেষে একটা অধ্যায় জুড়ে দিয়ে লালন সম্পর্কের তথ্যের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করেছেন।
মূল প্রসঙ্গটা বিয়ে। আমার চোখ আটকে গেছে ওই অংশটুকুতেই। বছর কয়েক আগে সেই ছোটবেলা থেকে লালনের জীবন থেকে শেখা যে কথাগুলো বিয়ের বিপক্ষে যুক্তি-তর্কে উল্লেখ করতাম, সুনীল সেই কথাগুলোকেই সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছেন–ভানুমতী ঠাকুরণের সাথে প্রথমে লালনের যে কথাগুলো হয়েছিল– অনেকের পড়া আছে, কেউ চাইলে আবার বইটি খুলে পড়তে পারেন, তবু ওই অংশটুকু তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না–
//একই ঘরে রাতের পর রাত দুটি পৃথক চাটাইয়ে শুয়ে থাকে ভান্তি আর লালন। কথাবার্তা বিশেষ হয় না। যে-যার সময় মতন ঘুমিয়ে পড়ে। এমনও হয়, অন্যদের সঙ্গে আলাপচারী করতে করতে লালনের অনেক রাত হয়ে যায়, সে যখন ঘরে আসে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে ভান্তি। আবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে লালন জেগে ওঠে, বেরিয়ে পড়ে। তখনও ভান্তি জাগেনি, লালনের সঙ্গে তার দেখাই হয় না।
সেরকমই এক রাতে, যাতে ভান্তির ঘুম না-ভাঙে সেই জন্য লালন যতদূর নিঃশব্দে সম্ভব চাটাইটা পেতে শুয়ে পড়ল। তারপর সবেমাত্র তার ঘুম এসেছে, ভান্তি নিজের চাটাইয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, আপনে ঘুমাইলেন নাকি, সাঁই?
লালন চোখ মেলে বলল, না।
ভান্তি বলল, আপনের সাথে তো আমার কথাই হয় না। আমারে কি মনে আছে? আমি কেডা।
লালন বলল, মনে থাকবে না কেন? তুমি ভান্তি ঠাইরেন, না, না, ভানুমতী ঠাকুরানি।
আমারে শুধু ভান্তি ডাকলেই হবে। কমলিদিদি আমারে একটা কথা। জিজ্ঞাসা করতে কইছে। জিগাই?
জিগাও। যা মনে আসে সবই আমারে জিগাইতে পারো।
আমি সব শুনছি। আমারে জীয়ন্তে পুড়াইয়া মারার জন্য অরা নিয়া গেছিল শ্মশানে। আমার চৌদ্দো পুরুষের ভাইগ্য, সেই রাতে আপনেরা সেইখানে আইস্যা পড়েন। আমার হাঁটনের ক্ষমতা ছিল না, আপনে আর মনসুর মিঞা আমারে পিচ্ছিল পথ দিয়া কত কষ্ট কইরা লইয়া আসছেন। নাইলে আমি সেই শ্মশানেই পইড়া থাকতাম, আমারে ভূত-পেতনিতে ছিঁড়া খাইত। কী, ঠিক কি না!
সে রাতে বড়ই দুর্যোগ ছিল। ভূত-পেতনিও বাহির হয় না। তুমি বাঁইচ্যা গেছ তোমার প্রাণশক্তির জোরে। আমরা নিমিত্ত মাত্র।
সাঁই, আমি নিমিত্ত বুঝি না। আমি বুঝেছি, তুমি আর মনসুরই আমার সাক্ষাৎ প্রাণদাতা। কিন্তু প্রাণ দিয়া আবার পরিত্যাগ করতে চাও ক্যান?
পরিত্যাগের প্রশ্ন আসে ক্যামনে, ঠাইরেন? এখানে আইস্যা তুমি নতুন জীবন পাও নাই? পুরানো সব কথা ভুলে যাও, তাতেই শান্তি পাবে।
আমি নতুন জীবন পাইছি ঠিকই। সব কিছুই নতুন নতুন লাগে। এক একদিন ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম চক্ষু মেলে গাছপালার মাথার উপর দিয়া সুন্দর আকাশ দেখে ভাবি, সত্যি বুঝি স্বর্গে আসছি। সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত কেউ একটাও কুবাক্য বলে না আমারে। এমনও যে জীবন হয়, স্বপ্নেও ভাবি নাই।
বাঃ, বেশ কথা। তুমি যে সকলের সাথে মানায়ে নিতে পারছ, সেটা আমার ভালো লাগে।
তুমিই এই জঙ্গলের মধ্যে একখান ছোট স্বর্গ গড়েছ।
যাঃ, একেবারে বাজে কথা। এসব কে বলেছে তোমারে? আমি আর কালুয়া নামে একজন প্রথম এসেছিলাম এখানে এই যা। তারপর একে একে আরও অনেকে এসে এটা গড়ে তুলেছে। সকলেই সমান অংশীদার। আমি তার বেশি কিছু না।
ঠিক আছে, এবার আসল কথা কই? তোমার কি বিরক্ত লাগছে? ঘুম আইস্যা গেছে? তাইলে চুপ করি।
লালন বলল, না, ঠাইরেন। সারা রাইত গল্প করলেও আমার বিরক্ত লাগে। আগে একটা বিড়ি খেয়ে লই?
অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে বেড়ার ধার থেকে বিড়ির বান্ডিল খুঁজে নিল লালন। তার বালিশের নীচেই থাকে চকমকির পাথর।
চকমকি ঠুকে ঠুকে বিড়ি ধরাতে কিছুটা সময় লাগল।
তারপর বড় একটা টান দিয়ে জে বলল, এবার কও।
ভান্তি বলল, মাইয়া মানুষের একটা অবলম্বন লাগে। লতার মতন।
লালন বলল, ক্যান, ক্যান, মাইয়া মানুষরা নিজের পায়ে শক্ত হয়ে খাড়াইতে পারে না?
পারে, তাও কেউ কেউ পারে। সক্কলে পারে না। সোজা বৃক্ষ হওনের চেয়ে লতা হইতেই বেশি ভালো লাগে। আমারও তাই ভালো লাগে। নইলে স্বর্গসুখও কেমন যেন আলুনি লাগে। আঝালি। আমগাছের গায়ে আলোকলতা দ্যাখছো? কী সুন্দর দেখায়।
আলোকলতার মূল নাই।
সাঁই, তুমি আর মনসুর আমার নবজীবন দাতা। এর মইধ্যে মনসুরের ঘরে বউ আছে, দায়-দায়িত্ব আছে। তোমার তো সেরকম কেউ নাই। তবে তুমি কেন আমারে নেবা না? কমলি এই কথাই জিগাইতে কইছে।
নেবা… মানে, ঠিক কী?
আমারে তোমার জীবনসাথী করে লও। আমার তো পশ্চাৎ-জীবন আর কিছু নাই!
জীবনসাথী কথাটারও তো অনেকরকম অর্থ হয়।
সাঁই, আমার বিদ্যাশিক্ষা নাই, তা বলে একেবারে নির্বোধ তো না। তুমি আমারে ভাবের কথা শুনাইয়ো না। রূপ-অরূপের কথা বোলো না। হেঁয়ালি কইরো না। সোজাসুজি, সাধারণ মানুষের মতন, জীবনসঙ্গী যারে বলে–
ঠাইরেন, আমি তোমারে সোজাসুজিই কই। আমি তোমারে বিয়া-শাদি করতে পারব না। তুমি যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকো।
ক্যান বিয়া করতে পারবে না? আমি হিন্দু, তাই? আমার মুসলমান হইতে আপত্তি নাই।
হিন্দু-মুসলমানের কথাই আসে না। স্ত্রীলোকেরা বিবাহ করতে চায় কেন? তারা একটা স্বামী চায়, সংসার চায়, সন্তান চায়। আমি তেমন কিছুই দিতে পারব না। সংসার কোথায়? এ তো মায়ার সংসার! কবে খানখান হয়ে যাবে তার ঠিক নাই। আর সন্তান…
আমার সংসার চাই না। তুমি আমারে তোমার পাশে রাখলেই হইল।
কিন্তু আমি তোমাকে সন্তানও দিতে পারব না। সেজন্য তুমি কষ্ট পাবে। পরে আমারে দুষবে।
কেন, সন্তান দিতে পারবা না কেন? তুমি কি… তাইলে আমিও…
না, না, সেসব কিছু না। ক্ষমতা থাকলেও আমি সন্তানের জন্ম দেওয়ায় বিশ্বাস করি না।
ক্যান?
বুঝাইয়া বলা শক্ত। তবে আমার মনে হয়, সন্তানের পিতা-মাতারা বড় স্নেহে অন্ধ হয়। নিজের সন্তানদের বুকে চেপে রাখে, অন্যের সন্তানদের ঠিক সেইমতো ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসার এই ভাগাভাগি আমার সহ্য হয় না।
অদ্ভুত কথা। সক্কলেই এমন হবে নাকি?
হয়তো হয় না। হয়তো আমি কোনও সন্তানের বাপ হলে আমিই স্বার্থপর হয়ে যাব! সেইজন্যই আমি—
সাঁই, একটা সত্য কথা বলবে? তুমি কি স্ত্রীলোকদের পছন্দ করো না? তুমি কি তাদের দিকে চাইতেও চাও না? মুখ ফিরায়ে থাকো?
আমার এখন কী হইছে, মিথ্যা কথা মুখেই আসে না। তোমারে কী করে বুঝাব? নারীরা তো মাধুর্য রসের আধার। আমি কি তাদের থেকে মুখ ফিরায়ে থাকতে পারি? তাদের একটুখানি হাসি, তাদের একটুখানি ভঙ্গি দেখলেই আমার মনের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকায়। এমনকী নারীদের পায়ের পাতা দেখলেও, এটা আমার একটা গোপন কথা, ইচ্ছা করে, সেই পায়ের পাতা বুকে চেপে ধরি।
বুঝেছি। আমি তেমন কেউ না। তোমার কল্পনায় অন্য নারী আছে।
তাও ঠিক না। এক-একসময় তুমিও তো ডানা-মেলা পরি হয়ে যাও। সত্য কথা এই যে, ইচ্ছা করেছে, তোমারে বুকে ধরে রাখি। কিন্তু…
কিন্তু কী? কেন এইসব কথা আমারে আগে বলো নাই?
নারী ও পুরুষের যেরকম মিলনে সন্তান জন্মায়, আমি যে সেইরূপ মিলন চাই না। কোনও নারীকে কাছে পেতে চাইলে সে তো তেমন মিলন চাইতেই পারে। তখন আমি রাজি না-হলে সে কষ্ট পাবে। তাই আমি…
এরপর একটুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইল। একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে ভান্তি বলল, এতক্ষণ যা কথা হইল সব মুইছা ফেলো। সব সাদা। এবার আর একটা কথা কইতে পারি?
লালন বলল, অবশ্যই পারো। বলল, বলো—
ভান্তি বলল, একলা এই চাটাইতে শুইতে এক-এক সময় বড় ভয় ভয় করে। আমি তোমার পাশে গিয়া একটু শুইতে পারি? বেশিক্ষণ না।
লালন বলল, এসো–
ভান্তি উঠে এসে তার পাশে শুয়ে পড়তেই লালন দুহাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিল নিজের বুকের আশ্রয়ে।
এবার শুরু হল ভান্তির কান্না।
লালন বিভ্রান্ত হয়ে বলল, একী, কান্দো ক্যান? আমি ছুঁইলে যদি তোমার অসুবিধা হয়…
কান্নার ফোঁপানির মধ্যেই ভান্তি বলল, না, না, কথা কইয়ো না। কিছু কইয়ো না।//
আমিও আপাতত আর কিছু কইলাম না… শুধু আজব (তরুণ) মুন্সির মতো মনে মনে ভাবছি–আমি কেনো লালন হইলাম না…
Leave a Reply