সেফুদা যখন বলছিলেন–‘কী, হিংসে হয়?’–তখন আসলেই ভাবতে বসেছিলাম–কাকে হিংসা হয়… কিন্তু সেফুদা বা অন্য কারো মতো হতে চাই নি কখনো। আমি আমার মতো…
হিংসে হয়–তবে কোনো ব্যক্তিকে নয়, ব্যক্তির গুণকে। আর ব্যক্তির দোষকে?–হ্যাঁ, তা-ও! দোষ-গুণ সবার মধ্যেই কমবেশি আছে। আর সব দোষের মধ্যে যে দোষটাকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, সেটা হলো–স্ববিরোধিতা। এমন নয় যে নিজের মধ্যে স্ববিরোধিতা নেই–আছে, মাঝে মাঝে সেগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করিও বটে, ফেসবুকে দু-চার লাইন লিখিও। তবে আশে-পাশের সাবলাইম খচ্চরগুলো স্ববিরোধিতাকে যে উচ্চ লেভেলে নিয়ে গেছে দেখতে পাই–ওই লেভেলে নিজেকে নিতে পারছি না বলে আসলেই হিংসে হয়।… বাকি দোষগুলো না হয় পরে হবে, আগে গুণগুলোর কথা বলি যেগুলোকে হিংসে হয়।
কেউ সুন্দর বাঁশী বাজায়, কেউ সুন্দর দোতারা বাজায়–হিংসে হয়–আহা, আমিও যদি বাজাতে পারতাম। (তাদের মতো সুন্দর না হলেও সমস্যা ছিল না–নিজের মতো বাজাতে পারলেও হতো।) কেউ সুন্দর গান করে, কেউ সুন্দর ছবি আঁকে, কেউ সুন্দর কোলাজ-কার্টুন বানায়, কেউ সুন্দর কবিতা লেখে, কেউ সুন্দর লেখালেখি করে, কেউ সুন্দর বাগান করে, কেউ সুন্দর ফসল ফলায়… কেউ প্রেম করে, কেউ ভালোবাসে, কেউ ভালো না বেসেও ভালোবাসি বলে… কেউ সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে মোহ-মায়ার সংসার ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ায়–হিংসে হয়।
সংসার ত্যাগ ব্যাপারটাকে কি গুণের মধ্যে ফেলা যায়? আগে ফেলতাম, ব্যক্তিগত ভাবে এখনো ফেলি। তবে ব্যাপারটা বোধহয় গুণ নয়, দোষের–সবচেয়ে বড় দোষের। আমরা সিদ্ধার্থ-নিমাই থেকে শুরু করে সংসারত্যাগী মানুষগুলোকে দোষ দিয়ে থাকি; তাদেরকে ভীরু-কাপুরুষ বলা থেকে শুরু করে আরো অনেক ভাবে সমালোচনা করি। আসলে সংসার করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় গুণ।
সংসার করতে পারার গুণটা আমার মধ্যে নেই, তবুও সংসার পেতেছি।–সবচেয়ে বড় স্ববিরোধিতা এখানেই। এছাড়া আমি প্রচণ্ডরকম অলস, ঘরকুনো, অসামাজিক–কোনো কিছু শেখার ধৈর্য্য নেই, কোনো কিছু করার যোগ্যতা নেই। সর্বোপরি একা থাকতে যেসব যোগ্যতা লাগে, তারও কিছুই নেই। তবুও একা থাকতে চাই। আবার চাই–কেউ আমার বাজারটা করে দিক, রান্নাটা করে দিক, খাবারটা বেড়ে দিত… এমনকি কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু একটা টাইপ করতে করতে যদি খাওয়ার সময় হয়ে যায়, তখন মনে হয় কেউ একটু খাইয়ে দিক। কিন্তু কারো জন্যে আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে না। অর্থাৎ প্রচণ্ডরকম স্বার্থপরও বটে। এরকম কাউকে দিয়ে দুনিয়ার কোনো উপকার তো দূরের কথা, কোনো মানুষেরই সামান্য উপকার হয় না। আবার এই কোনো কিছু করতে না পারাটাই পরোক্ষভাবে নিজেকে আড়ালে রাখার একটা বড় উপকার করে দিয়েছে।
যা হোক, কয়েকদিন আগে ফেসবুকের ‘অসামাজিক গ্রুপে‘ একটা প্রশ্ন করেছিলাম–//কোনো দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে আলাদা করে নারী ও শিশুর সংখ্যা উল্লেখ করা হয় কেন?//–নারী ও শিশুরাই মূলত ‘ভবিষ্যত’। একজন পুরুষ মারা গেলে পৃথিবীর যতটা না ক্ষতি হয়, একজন নারী বা শিশু মারা গেলে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি।–এই ভাবনাটা এখন কেউ সেভাবে ভাবে কি না, জানি না, তবে সুকান্ত যখন ‘ছাড়পত্র’ লিখেছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন। আর তাই তিনি পৃথিবীর জঞ্জাল সরিয়ে এ বিশ্বকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। আর এ কারণেই যারা সংসারে থেকে শিশুদেরকে বড় করা এবং এ পৃথিবীটাকে শিশুদের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার কাজটা যথাযথ ভাবে পালন করেন, তাদেরকে সবচেয়ে বেশি হিংসে হয়।
নতুন বছরে কার কী অঙ্গীকার জানি না–আমার শুধু হিংসে করার অঙ্গীকার…
শুভ হোক সবার।
Leave a Reply