লিখেছেন : আকাশ মালিক
আমার নিজের কানে শুনা সত্য একটি ঘটনা বলি। প্রায় ষাট বছর পূর্বের ঘটনা। আমাদের গ্রামের আমার দূর সম্পর্কের এক খালার মুখ থেকে ঘটনাটি শুনেছিলাম। তাঁরা তিন বোন ছিলেন। গরীব পরিবার, পান্তা আনতে নুন ফুরায় অবস্থা। গাভী গরু জমিজমা কিছুই ছিলনা। তিন জনেরই বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামের ভিন্ন পাড়ায়। বড় খালার তৃতীয় সন্তান (ছেলে) জন্মের কিছুদিনের মাঝে খালা মারা যান প্রসবজনীত কোনো একটা রোগে আর এর ঠিক দুই বছর পরে ছোট খালাও তাঁর তৃতীয় সন্তান (মেয়ে) জন্মের দুই মাসের মাথায় মারা যান রক্তশুন্যতায় ভোগে। উভয় শিশুকে মেজো খালা তাদের বাড়ি গিয়ে তাঁর বুকের দুধ পান করায়েছিলেন। সেই ছেলে এবং মেয়ে বড় হওয়ার পর, বড় খালার ছেলের সাথে ছোট খালার মেয়ের বিয়ে হয়। গ্রামাঞ্চলে খালাতো বোনের সাথে খালাতো ভাইয়ের বিয়ে প্রায়ই হয়ে থাকে। ৮১ সালে প্রথম দেশে যাওয়ার পর খালাকে দেখতে গিয়েছিলাম। কোনো একটি ঘটনার সুত্র ধরে কথা প্রসঙ্গে এই ঘটনাটি উল্লেখ করে মেজো খালা বলেছিলেন ‘মা হারা সন্তান জানে মা কী ধন’। বিষয়টি মেজো খালা ছাড়া গ্রামের আর কেউ জানতেন কি না জানিনা। আজ ঘটনাটি মনে পড়লো ‘শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’ বন্ধ হওয়ার খবরটা শুনে।
এরা যদি নিজেদের এক আদম আর এক হাওয়ার সন্তান মনে করেন তাহলে কিসের ভাই-বোন আর কিসের বিয়ে? তাদের মতানুযায়ী কোনো না কোনো ভাবে তো আদম সন্তান সবাই একে অন্যের ভাই-বোন। ভাই বোনের সঙ্গম ছাড়া পৃথিবীতে এতো মানুষের জন্ম হলো কী ভাবে? মুসলমান সকলেই জানেন নবি মুহাম্মদ তার আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথে আপন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। চাচাতো ভাই আলীর সাথে তার আপন মেয়ে ফাতিমাকে আর আপন চাচা আবু লাহাবের দুই ছেলের সাথে নিজের দুই কন্যা রোকেয়া ও কুলসুমের বিয়ে দিয়েছিলেন। আরবের রীতি অনুযায়ী কোরায়েশ বংশের শিশু মুহাম্মদই শুধু মা হালিমার বুকের দুধ পান করেন নি, প্রতি বৎসরই বিভিন্ন গোত্রের নারীর দুধ পান করেছেন বিভিন্ন বংশের শিশুরা। কেউ কোনোদিন লিখে রেখেছিল কার দুধ মা কে, আর কার দুধ মার মেয়েকে কে বিয়ে করেছে? যে হালিমার দুধ পান করেছেন মুহাম্মদ, সেই হালিমারই দুধ পান করেছেন মুহাম্মদের আপন চাচা হামজা ও আবু সুফিয়ান। সেই হিসেবে আবু সুফিয়ান আর মুহাম্মদ আপন দুধ ভাই। মুহাম্মদ কোন শরিয়ার নিয়মে তার আপন দুধ ভাই আবু সুফিয়ানের মেয়ে উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করলেন? মুহাম্মদ, আবু সুফিয়ান আর উম্মে হাবিবা এদের তিন জনের দেহে মা হালিমার দুধের রক্ত বহমান নয় কি?
১৯৯৯ সালের আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা মায়ের দুগ্ধ বঞ্চিত মা হারা অসহায় অভাগা শিশুদের বাঁচাতে আর বুকে অপর্যাপ্ত দুধ বা দুধশুন্য গর্ভধারিনী মায়েদের মনের কষ্ট নিরসনে একটি মানবিক উদ্যোগ ‘শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’ উদ্বোধন করেছিলেন। আজ ২০২০ সালের হেফাজতের শেখ হাসিনার চোখের সামনে সেই ইনস্টিটিউটটি বন্ধ হয়ে গেল তিনি বাঁচাতে পারলেন না। ১৯৯৯ সালের শেখ হাসিনা আর ২০২০ সালের শেখ হাসিনার মধ্যে এই হলো পার্থক্য। হেরে গেছেন হাসিনা, হেরেছে বাংলাদেশ আর জয়ী হয়েছে তারা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেনা, বাংলাদেশের জন্ম যাদের কাম্য ছিলনা। যারা একটি শিশু জীবন নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়না। আমাদের বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত সুশীল সমাজে আজ পিন পতন নীরবতা, কারো কিছু বলার নেই, এর প্রতিবাদে একটি শব্দও লেখার প্রয়োজন তারা বোধ করলেন না। তবে কি সারা জাতি ১৫ শো বছরের পুরনো আরবের অমানবিক শরিয়া আইন সমর্থন করে মেনে নিলেন? ষোল কোটি মানুষের মাঝে কারো মনে কি প্রশ্ন জাগলোনা, শরিয়ার আইন বাঁচানো প্রয়োজন নাকি একটি শিশুর প্রাণ বাঁচানো অধিক প্রয়োজন?
Leave a Reply