লিখেছেন : চার্বাক কাজী
ছেলেবেলা থেকেই শুনছি, ঢাকা হচ্ছে মসজিদের নগরী।
অদ্ভুত এক খেলো গর্বও লুকিয়ে আছে এই নামকরণটিতে, যদিও আদতে এই ঢাকা মূলত যত্রতত্র মূত্রত্যাগ, শব্দসন্ত্রাস আর নির্মম শব্দতাণ্ডবের শহরও। সেসব কথা অবশ্য অনুহ্যই থাকে।
ভোর হতে না হতেই ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ভেসে বেড়ায় ৯০-১০০ ডেসিবেলের লাউডস্পিকারে কর্কশ এক বিজাতীয় গান, যার ত্রিমুখী, চতুর্মুখী, পঞ্চমুখী আক্রমনে ছেয়ে যায় নগরীর প্রতিটি গৃহকোণ … এর নাম আযান; শুনেছি গান নাকি ইসলামে হারাম, কিন্তু জনমানসে ত্রাস সৃষ্টি করা আযান নামের এই শব্দ-সন্ত্রাস আবার বড়ই আরাম। মুসলমানদের বোঝা বড় দায়!
চরম ঔদ্ধত্ব ও আত্মতুষ্টি সাথে একদল অর্ধ-শিক্ষিত দম্ভী তাদের কর্কশ স্বরে ঘোষণা করতে থাকে,
আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাহ,
[আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই]
আশহাদু আল্লামুহাম্মাদার রাসুল্লাহ,
[আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত দূত]
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,
[আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই]
এবং এই মিথ্যাচার চলতেই থাকে দিনভর – একবার নয়, দু’বার নয়, প্রতিদিন পাঁচ পাঁচ বার, গোটা বছর ভরেই।
নির্লজ্জ, বেহায়া, দুর্বিনীত, বেলেল্লা, ও বেশরম এই মুমিন মুসলমানেরা প্রায়শঃই অযৌক্তিক একটি দাবী করে – ইসলাম হল শান্তির ধর্ম, ইসলাম কোন ধর্মকে ছোট করে দেখেন,যার যার ধর্ম তার তার, তোমাদের ধর্ম তোমাদেরই থাকুক, আমার ধর্ম আমার ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি;
ইসলামে – কোরআনে ও হাদীসে পরধর্ম সহিষ্ণুতার শিক্ষা আছে এমন মজাদার সব কৌতুকও তাঁরা বলে থাকেন; অথচ দিনভর পাঁচ বার চেঁচিয়ে অপরাপর ধর্মের প্রতি বিষোদগার করাকে তাঁদের গ্রহণযোগ্য আচরণ বলে মনে হয়।
শিক্ষার নুন্যতম ছাপ থাকলেও কোন সভ্য কোন সমাজের কোন মানুষ যেটা করবেনা, সেটিকেই উনারা মাইক বাজিয়ে পাঁচবেলা বলে থাকেন, গর্বের সাথে বলে থাকেন।
ঢাকার প্রায় শতভাগ মানুষই, সেই সাথে অন্যান্য শহরগুলোর নাগরিকেরাও শব্দদূষণের কারণে নানা রোগে ভুগছেন।
রাজধানীর প্রায় ১২ ভাগ নগরবাসী মাথাব্যথা ও চোখে পানিপড়া, ১৮ ভাগ অবসাদ,
১৫ ভাগ অনিদ্রা, ২৮ ভাগ বদমেজাজ, ২৬ ভাগ কানে কম শোনা এবং তিন ভাগ লোক
অন্যান্য রোগে ভুগছেন, সেটাও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের জাতীয় দৈনিক
পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, ১৫ বছর পর এই মহানগরের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ লোক তাদের শ্রবণশক্তি হারাবে বা শ্রবণপ্রতিবন্ধী হবে। গবেষণাপত্রগুলো প্রামাণ্য উদাহরণ উপস্থাপন করছে, এমনকি সরকার রীতিমত নীতিমালা প্রণয়ন করে এটা স্পষ্ট করেছে যে, গবেষকদের এই দাবীগুলো সঠিক, দেশে শব্দদূষণ আছে এবং তার প্রতিকারও প্রয়োজন; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে শব্দদূষণ রোধে নীতিমালা থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ নেই।
শব্দদূষণ বিধিমালাটি মোবাইল কোর্ট আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও দূষণ রোধে কার্যকর কোনো ভূমিকা আজও দৃশ্যমান নয়।
পুলিশের কাছে গেলে পাওয়া যায় শব্দ মাপার যন্ত্র না-থাকার অজুহাত।
শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬ নামের এই বিধিমালার মূল কথাঃ মানুষের কানের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবল।
সে কারনেই নীরব এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিনের বেলায় (ছয়টা-নয়টা) ৪৫ ডেসিবল, রাতে (নয়টা থেকে সকাল ছয়টা) ৩৫ ডেসিবল। একইভাবে দিনে আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল। মিশ্রণ এলাকায় (আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা হিসেবে একত্রে ব্যবহূত এলাকা) দিনে ৬০ ডেসিবল, রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল, রাতে ৬০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল, রাতে ৭০ ডেসিবল।
রাজধানীতে ব্যবহৃত যানবাহন থেকে উৎসারিত
শব্দ ৯৫ ডেসিবেল, মাইক্রোফোনের শব্দ ৯০-১০০ ডেসিবেল, কারখানার শব্দ ৮০-৯০
ডেসিবেল, হোটেল ও সিনেমা হলের শব্দ ৭৫-৯০ ডেসিবেল, উৎসব অনুষ্ঠানের শব্দ
৮৫-৯০ ডেসিবেল, বেবিট্যাক্সি ও মোটরসাইকেলের শব্দ ৮৭-৯২ ডেসিবেল,
বাস-ট্রাকের শব্দ ৯২-৯৪ ডেসিবেল পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বিশেষ করে যারা
মসজিদের খুব কাছে থাকেন, তাদের জন্য মাইক্রোফোনের ৯০-১০০ ডেসিবেল মাত্রার
শব্দ খুবই বিপজ্জনক৷ বিশ্বজুড়ে মাইক বাজিয়ে আজান দেয়া তাই একে একে নিষিদ্ধ
হচ্ছে।
বাংলাদেশে পরধর্মের প্রতি অসংবেদনশীল এবং বোধশূন্য, অনুভূতিহীন ও অসাড় চৈতন্যের মুমিন মুসলমানেরা শুধুমাত্র তাঁদের ধর্মানুভুতির নামে সমগ্র দেশবাসীর, এমনকি নবজাতক শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে চলেছে তাঁর কি কোন প্রতিকার নেই?
এ নিয়ে মামলা করলে অসভ্য এই দেশের চাটুকারদের আদালত আদৌ কি কর্ণপাত করবেন?
Leave a Reply