লিখেছেন : বৈশালী রহমান
রাজা রামমোহন রায়কে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। কারণ, তিনি নারীদের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। এই আন্দোলন করার জন্য তাঁকে “মানুষবাদ” প্রমোট করা লাগে নাই। কারণ এক্ষেত্রে ভিক্টিম ছিল নারী, পুরুষ না। কাজেই, তিনি নির্দিষ্টভাবে নারীদের উপর এই অত্যাচার বন্ধ করার কথাটা উল্লেখ করেই এই অত্যাচার প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর, বাঙালির আরেক শ্রদ্ধাভাজন। তিনিও “মানুষের” বহুবিবাহ বন্ধ করা বা “মানুষের” বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য আন্দোলন করেন নাই। কারণ তখনকার সমাজে “মানুষ” একটার পর একটা বিবাহ করতো না। করতো পুরুষ। আর এক্ষেত্রে ভিক্টিমও “মানুষ” হতো না। হতো নারী। আবার স্ত্রী মারা গেলে পুরুষের বিবাহ করতে বাধা ছিল না। বাধা ছিল নারীর, যদি তার স্বামী মারা যেতো। কাজেই বিদ্যাসাগরকে পুরুষের বহুবিবাহ বন্ধ এবং নারীর বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য একের পর এক প্রস্তাবনা লিখতে হয়েছিল।
রোকেয়াকে নারী শিক্ষার উপকারিতা বিষয়ক লেখালেখি করতে হয়েছিল। নারীদের পড়ালেখা শেখানোর জন্য পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়েছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে আসা লেগেছিল। নারীদের অবরোধপ্রথা নিয়ে প্রবন্ধ, স্যাটায়ার লেখা লেগেছিল। “মানুষ”দের না। কারণ লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হওয়া বা অবরোধপ্রথার অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া সে সময় সমগ্র মানবজাতির সমস্যা ছিল না। শুধু নারীর ছিল। তসলিমা নাসরিন একের পর এক নারীর বঞ্চনা এবং লড়াই এর কাহিনি লিখে গেছেন। কারণ বিয়ের পর কেরিয়ার ত্যাগ, “স্বামীসেবা” করতে ব্যর্থ হলে মাইর খাওয়া, প্রেমিক এবং তার বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়া, এগুলো একান্তই নারীর উপর হওয়া অত্যাচার এবং বঞ্চনা। এখানে সমগ্র মনুষ্যজাতি টেনে নিয়ে আসার অবকাশ নাই।
খোদ আমেরিকায় মেয়েরা ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছে ১৯২০ সালে। এমনি এমনি সেই অধিকার আসে নাই। আন্দোলন করা লেগেছে। সংগ্রাম করা লেগেছে। সেই আন্দোলন এবং সংগ্রামে কেউ বলে নাই, “মানুষ” এর ভোটের অধিকার চাই। বলেছে, নারীর ভোটাধিকার চাই। কারণটা সহজ। এক্ষেত্রেও ভোটাধিকার হতে বঞ্চিত হতো নারী। সমগ্র মানবজাতি না।
বাংলাদেশে এখনও নারীর পুরুষের সমান সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার নাই। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নারী। পরিবারে টাকাপয়সার সমস্যা থাকলে এখনও মেয়েটাকে বঞ্চিত করে ছেলেটাকে পড়ানো হয়। ছেলেদের পছন্দমতো কেরিয়ার বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও মেয়েদের কেরিয়ার বেছে নেওয়াটা এখনও “স্বামী শ্বশুরবাড়ির” অনুমতি এবং “বাচ্চা পালার সুবিধা”র উপর নির্ভর করে। ও, বলতে তো ভুলেই গেছি। বিয়ের পর এখনও মেয়েদেরই পরিবার ছেড়ে ছেলের মা বাপের সাথে বাস করতে হয় এবং এটাই নাকি সংস্কৃতি। বছর এখনও ভালো করে শুরু হয় নাই, ধর্ষণের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এইরকম একটা দেশে বাস করে, এইরকম সমাজ সংস্কৃতিতে বড়ো হয়ে এখন বড়ো বড়ো পজিশনে বসে যারা নারীবাদ কথাটা এলেই “মানুষবাদ” নিয়ে আসেন, নারী দিবস নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করেন, “মানুষ দিবস” নাই কেন প্রশ্ন তুলেন, আমি তাদের অত্যন্ত সম্মান করি। কারণ আপনাদের অনেক কারেন্ট। ওই কারেন্ট দিয়ে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও দশ বছর বাংলাদেশ চলতে পারবে।
Leave a Reply