লিখেছেন : কবিতা রায়
গীতাকে মহাভারত থেকে আলাদা করে পড়লে কোনোদিনই আসল অর্থ বোঝা যায়না। ঠিক যেমন জেনারেল এনাটমি বাদ দিয়ে শুধু হাড়ের ডাক্তারি পড়লে ডাক্তার হওয়া যায়না।
গীতার আবির্ভাব হয়েছে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধের কারণ হল পান্ডবদের জমি কৌরবরা দখল করে নিয়েছে, সেটা পান্ডবরা ফেরত চায়। এদিকে বিনা যুদ্ধে কৌরবপক্ষ এক ইঞ্চিও জায়গা না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে।
এই পরিস্থিতিতে পান্ডব পক্ষের সবচেয়ে বড় যোদ্ধা অর্জুন বলছেন আমি যুদ্ধ করব না। তিনি কৃষ্ণকে বলছেন যুদ্ধ না করে বিকল্প কোনো পথ বলে দিতে। ঠিক যেমন বাংলাদেশের, পাকিস্তানের, কাশ্মীরের হিন্দুরা তাদের জমি হারিয়ে পথেপথে ঘুরেছে কিন্তু যুদ্ধ করে নিজেদের জমি ফেরত নেবার ব্যাপারে কিছুতেই রাজী হয়নি। অর্জুনও ঠিক তাদেরই মতো বলছেন, আমি নাহয় বাকি জীবনটা রিফিউজি হয়ে পথে পথেই ঘুরব, কিন্তু কিছুতেই যুদ্ধ করবনা। যারা আমাকে রিফিউজি করে দিয়েছে তারা আমার ভাই হয়। ওদের উপর অস্ত্র চালানোর কথা চিন্তা করলেই আমার হাত-পা কাঁপছে।
জবাবে কৃষ্ণ খুবই পরিষ্কার জানাচ্ছেনঃ
১) শত্রুর দখল থেকে নিজের অধিকারের জমি উদ্ধার করতে গেলে কোনো যোগমার্গ বা ধর্মশাস্ত্র দিয়েই তা সম্ভব নয়। একমাত্র উপায় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করা।
২) নিজের অধিকার ত্যাগ করে দেওয়াটা যোগীদের মানায়। তারা কোনোকিছু পেলে আনন্দিত হয়না, কোনোকিছু গেলে দুঃখ পায়না। কিন্তু সংসারে থাকতে গেলে এরকম হওয়া সম্ভব নয়।
৩) যারা তোমার সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তোমাকে রিফিউজি করে দেয় তারা কখনও তোমার আত্মীয় হতে পারেনা। শুধুমাত্র একই বংশে জন্মানো শরীর (অর্থাৎ একই ডিএনএ) হলেই আত্মীয় হয়না। আত্মার সম্পর্কে এবং মনের মিল থাকলেই আসল আত্মীয় হয়। যে কারণে আমিই তোমার সবচেয়ে বড় আত্মীয়।
৪) আমাকে যে যেমনভাবে ভজনা করে আমি তাকে সেই রূপেই দেখা দিয়ে থাকি। অর্থাৎ বন্ধু ভাবলে বন্ধুরূপে আসি, শত্রুতা করলে শত্রুরূপ দেখাই। তুমিও ঠিক তাই করবে। এতদিন ভালমানুষি দেখিয়ে সেটা করোনি বলেই দুর্যোধন তোমার চেয়ে দুর্বল হয়েও তোমাদের ক্ষতি করতে সাহস পেয়েছে। কারণ সে জানে যে অতিরিক্ত ধর্মজ্ঞান থাকার কারণে তোমরা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। যেসব ধর্ম এতকাল শিখেছ তারই কারণে তোমরা রিফিউজি হয়েছ। এবার সব ধর্ম ত্যাগ করে আমাকে অনুসরণ করো। যে যেমন ব্যবহার করবে তাকে তেমন রূপ দেখাও।
৫) কংসমামা আমার সাত ভাইকে জন্মানো মাত্রই বধ করেছিল। সেই মামাকে আমি জনগণের সামনে পিটিয়ে মেরেছি। সে কি আমার আত্মীয় ছিল না? শিশুপাল আমাকে একশতবার অপমান করার পর জনগণের সামনে তার মাথা কেটেছি। সে কি আমার আত্মীয় ছিল না? জরাসন্ধ যখন ১৭ বার আমাদের রাজ্য আক্রমণ করে রিফিউজি বানিয়ে দিয়েছিল তাকে কী আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম? শুধরে যাবার সুযোগ হিসাবে দুচারটে অন্যায় ক্ষমা করে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার একটা সীমা থাকে। যদি দেখা যায় ক্ষমা করে দেওয়া হবে জেনে কেউ আরো বেশি ক্ষতি করার সাহস পাচ্ছে তখন পাল্টা মার দেওয়াটাই ধর্ম। আমি তাই করেছি। তুমিও তোমার বাকি সব ধর্ম ভুলে গিয়ে আমার অনুসরণ করবে।
Leave a Reply