লিখেছেন : কবিতা রায়
শুরুতেই ধরে নেওয়া যাক যে কোনোকিছুকে প্রমাণ করা না গেলে সেটা অবাস্তব জিনিস। কিন্তু তার পরেও বস্তুবাদ জিনিসটাই আসলে এক অবাস্তব তত্ব। মানুষ কেবল বস্তু নয়, বরং অর্ধেক কল্পনা দিয়ে তৈরি। বাইনারি সিস্টেমের সংখ্যা নয় যে তাদেরকে বস্তুবাদী আর কল্পনাবাদী হিসাবে আলাদা করা যাবে। এরকম যারা করে সেই যুক্তিবাদীরাও আসলে একটা বাইনারি ধর্মের প্রচারক।
বাস্তব সত্যের একটা বিরাট সমস্যা যে মানুষ এর পিছনে একজোট হয়না। কোনো বাস্তব পরিকল্পনায় চলতে একজন নেতার পিছনে খুব বেশি হলে ১০০ থেকে ২০০ জন লোক পাওয়া যেতে পারে। এর চেয়ে বেশি মানুষকে একজন লিডার কোনোভাবেই বাস্তব যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে একটা কোনো কাজে লাগাতে পারবেনা। তাই বিরাট সেনাবাহিনী হোক বা বিরাট কর্পোরেট সংস্থা হোক, এর চেয়ে বড় টিম হলে ছোটো ছোটো উপনেতার মধ্যে কর্মীদের ভাগ করে দিতে হয়। এবং তাদেরকে একজোট রাখার জন্য একটা এমন কিছু লাগে যেটা পুরোপুরি বাস্তব নয়। সেটা হতে পারে কোম্পানী অথবা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নামে অথবা কোম্পানীর নামে আদেশ দিলে অনেক বেশি মানুষ তা পালন করে। অথচ সেগুলো আসলে অর্ধেক-কাল্পনিক সত্তা। পুরোপুরি কাল্পনিক সত্তার নামে আদেশ জারী করলে আরো অনেক বেশি মানুষ সেটা পালনের জন্য একজোট হয়। এটাই বাস্তব ঘটনা।
বারবার বলার মতো কথা যে বাস্তব কারণ দেখিয়ে একজন মানুষ খুব বেশি হলে ১০০ থেকে ২০০ জন লোককে একজোট করতে পারে। এর বেশি মানুষকে একসাথে নিয়ে চলতে গেলেই কাল্পনিক তত্ব দরকার হয়। ব্যাপারটা শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী কাল্পনিক গল্প শোনাতে পারেনা আর মোটামুটিভাবেে যে কোনো বুদ্ধিমান মেরুদন্ডী প্রাণীরই একটা দলে সদস্যের সংখ্যা এর চেয়ে কমই থাকে। সেটা সিংহের দল, হাতীর দল, কুকুরের দল হলেও। এর চেয়ে বেশি সংখ্যায় বুদ্ধিমান জীব কখনো কোনো বাস্তব কারণে একজোট থাকতে পারেনা। কিন্তু একটা কাল্পনিক নেতা বা সত্তা খাড়া করে তার নামে হুকুম জারী করলে কয়েক কোটি মানুষকে একসাথে নিয়ে চলা সম্ভব। যার বাস্তব প্রয়োগ হল রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদি। বাস্তবতা থেকে মানুষ হাজার ঠকেও সহজে শেখেনা, অথচ কথা কওয়া খরগোশের মতো কিছু কাল্পনিক জীবের গল্প দিয়ে মানুষকে অনেক মেসেজই দেওয়া সম্ভব, অনেক কিছুই শেখানো সম্ভব, আর সেটা নিয়মিতভাবে করা হয়েও থাকে।
শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম বিষয়ে কাল্পনিক জিনিসের বাস্তব প্রয়োগ দেখলে হয় অনেকের মনে হবে ওগুলো বোকা লোকেদের জন্য কাজে দেয়। তাই এবার সরাসরি বিজ্ঞানের মধ্যে ঢোকা দরকার। বাস্তবতা নিয়ে কারবার করা সবচেয়ে উন্নত বিজ্ঞানীদের মধ্যেও কাল্পনিক জিনিসের নিয়মিত প্রয়োগ আছে আর সেগুলো বিজ্ঞানেরই সমস্যার সমাধানে লাগানো হয়। যার অন্যতম উদাহরণ i অর্থাৎ ঋণাত্মকের বর্গমূল। বিজ্ঞান এটাকে কাল্পনিক সংখ্যা বলে স্বীকার করলেও এটা বিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানের কাজেই ব্যবহার হয়ে থাকে, রাজনীতি বা ধর্মে নয়। উচ্চস্তরের অঙ্কের বইয়েও এটি অবশ্যপাঠ্য। কাল্পনিক হলেই তা কোনো কাজের নয় এরকম দাবী বিজ্ঞান কখনোই করেনা। তবে শুনে বৈজ্ঞানিক হওয়া বস্তুবাদীদের ধারণা এরকমই।
আবার একবার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে মানুষ কেবলমাত্র বস্তু দিয়ে তৈরি নয়, বরং বাস্তব আর কল্পনার এক জটিল যৌগ। বাস্তব জগতে যেমন তাদের বহু প্রিয়বস্তু আছে, প্রিয় কাজ আছে, আশা আছে, তেমনই তার কাল্পনিক জগতেও এরকম অনেক কিছু আছে। এই বাস্তব আর কাল্পনিক জগতের মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলাটাই বাস্তব জীবন। শুধুমাত্র কাল্পনিক ধর্মের পিছনে ছুটে বাস্তবতাকে অস্বীকার করাটা যেমন অবাস্তব চিন্তা, শুধুমাত্র বাস্তব হিসাবে প্রমাণিত না হলেই সেটাকে ত্যাগ করার তত্বটাও ততখানিই অবাস্তব। মানুষ কোনো বাইনারি জন্তু নয় যে ০ আর ১ এর মধ্যে যেকোনো একটায় তাকে থাকতেই হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের মাঝামাঝি তার অবস্থান থাকে। আবার এই দুইয়ের বাইরেও থাকা খুবই সম্ভব।
Leave a Reply