লিখেছেন : কবিতা রায়
আদতে ভারতীয় সংবিধান লেখা হয়েছিল ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নির্দেশে। গান্ধীর মৃত্যুর পর তিনিই নেহেরুকে চালাতেন, আর নেহেরু চালাতেন কংগ্রেসকে। তাই ভারতকে দুর্বল করে রাখার জন্য ইংরেজরা ঠিক যেসব আইনকানুন আবিষ্কার করেছিল তার সবই ভারতের সংবিধানে আছে। যদিও সরাসরি সেগুলো লিখলে সমস্যা হবে বলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লেখা হয়েছে।
ইংরেজরা যখন প্রথমদিকে ভারত দখল করতে শুরু করে তখন তারা হিন্দুদের বুঝিয়েছিল যে বহিরাগত মুসলিমদের অত্যাচার থেকে তারা হিন্দুদের নিরাপদ রাখবে। এই সময়ে মুসলিমরা ছিল রুলিংপার্টি হিসাবে ইংরেজের বিরুদ্ধ শক্তি। এইখানে বিভেদ তৈরি ছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল এর প্রথম ধাপ। এতে তারা অনেক হিন্দু রাজাকে মিত্র হিসাবে পেয়েছিল। তাদের মধ্যে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ নানাসাহেব, তাঁতিয়া টোপি, ঝাঁসির রাণী ইত্যাদির নাম ইতিহাসে সকলেই পড়েছে।
কিন্তু এই মিত্ররা যখন ইংরেজের আসল মতলব অর্থাৎ রাজ্য দখলের মতলব বুঝতে পারল তখন হল সিপাহি বিদ্রোহ। বিদ্রোহ দমন করার পর ভারতের অধিকার কোম্পানীর হাত থেকে মহারাণীর হাতে গেল। সিপাহি বিদ্রোহের মত অবস্থা যাতে আর না হয় সেজন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলটা বানিয়ে দিলেন। যাদের কাজ ছিল দেশি রাজাদের তুলনায় ইংরেজ রাজত্বের সুবিধা প্রজাদের বোঝানো। অর্থাৎ ডিভাইডের দ্বিতীয় ধাপ হিসাবে রাজায়-প্রজায় বিভেদ বাড়ানো। এই ধাপে ইংরেজরা দেশি রাজাদের অত্যাচার থেকে প্রজাদেরকে বাঁচানোর কথা প্রচার করত। এখানে দেশি রাজারা ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধ শক্তি, তাই তাদের অত্যাচারের কথা এতদিনে ইংরেজদের মনে পড়ল। যখন একপক্ষে ছিল তখন দেখেও দেখেনি।
এইভাবে অনেকদিন চলার পর কংগ্রেসের প্রাচীন ব্রিটিশভক্ত নেতারা আস্তে আস্তে নবীন নেতাদের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়লেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। সেই উত্তেজনায় নবীন কংগ্রেসীরাও ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আর তখনই ইংরেজদের বিভেদনীতির তৃতীয় ধাপ হিসাবে এল সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি বা কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ড। যার মূল কথা ছিল ভারতের রাজনীতিতে জাতি ভিত্তিক প্রতিনিধির কোটা দেওয়া আর সেখানে সিডুলকাস্টদের আলাদা জাতি হিসাবে কোটা দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এই তৃতীয় ধাপে এল উচ্চজাতের হিন্দুদের অত্যাচার থেকে নিচুজাতকে বাঁচানোর প্রচার। যেহেতু এই সময়ে উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরা ইংরেজের বিরুদ্ধে চলে গেছিল তাই তাদের অত্যাচারের কথা মনে পড়ে গেল। যদিও গান্ধী এবং নেতাজী দুজনেই এইভাবে SC দের ালাদা জাতি স্বীকার করেননি, কিন্তু আম্বেদকর এই প্রস্তাব লুফে নিয়ে ইংরেজ ও মুসলিম লীগের সাহায্যে আন্দোলন করে এই কোটা আদায় করেছিলেন।
এরপর এল ১৯৪৫ সাল, যখন জাতিসঙ্ঘ থেকে ভারতকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। জিন্না দাবী করলেন হিন্দু মেজরিটি ভারতে মুসলমানেরা নিরাপদ থাকবেনা। ইংরেজরাও সেই দাবীকে হাওয়া দিতে থাকল। কারণ সে সময়ে হিন্দুরা ইংরেজ-বিরোধী, তাই তারা মুসলিমদের উপর অত্যাচার করবে এটাই স্বাভাবিক প্রচার। এটা ছিল বিভেদের চতুর্থ ধাপ।
মন দিয়ে ভারতের সংবিধান পড়লে ইংরেজিদের আমদানি করা এই তত্বগুলো পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে। সামনে বড় বড় ভাল কথা লেখা থাকলেও তারই ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজদের দেওয়া এইসব তত্বগুলো সুন্দরভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকে ভারতের স্বাধীনতালাভ অবধি সময়ে যারা ইংরেজকে যত বেশি সাহায্য করেছে, তাদের জন্য তত বেশি সুবিধা ভারতের সংবিধানে তথা আইন-কানুনে দেওয়া আছে।
Leave a Reply