মাস্টারবেশন ট্যাবু : রিয়েলিটি বনাম গিলটি
লিখেছেন : ডা. অপূর্ব চৌধুরী
London, England
মাস্টারবেশন । শুনলেই আঁতকে উঠে লোকে । এ নিয়ে ট্যাবুর শেষ নেই । সাথে আছে গিলটি ফিলিংস । কিন্তু রিয়েলিটি কি বলে !
নোবেল লরিয়েট বাট্রান্ড রাসেল সত্তর বছর বয়সে অটোবায়োগ্রাফি লিখতে গিয়ে অবলীলায় বলেছেন, চোদ্দ বছর বয়স থেকে বিয়ে না করার আগ পর্যন্ত মাস্টারবেশন অবসেস ছিলেন । বলা হয় উনিশ শতক পর্যন্ত মেডিক্যাল সাইন্স এবং সমাজে প্রচলিত ছিল যে – মাস্টারবেশন হলো একটি ডিজিজ ! এমনকি তখন পুরুষরা যাতে মাস্টারবেশন করতে না পারে, পেনিসে এক ধরনের রিং দিয়ে তালা লাগিয়ে রাখতো । নাম ছিল : Jugum penis । বিশ শতকে একই চিকিৎসক বিজ্ঞানীরা খুঁজে দেখলো যে – মাস্টারবেশন আসলে কিউর !
মাস্টারবেশন হলো ফাস্ট ফুড । অর্ডার দিলে তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, খেতেও ভারী মজা লাগে । দামে সস্তা ।
অনেকদিন থেকে কিছু পাঠকরা বলছিলেন – স্যার এটা নিয়ে কিছু লিখুন । কারণ কি ! গত কয়েকমাস সেক্স এন্ড রিলেশনশিপ নিয়ে অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছি মেডিক্যাল এন্ড এডুকেশনাল ভিউ থেকে । দেশি পিছিয়ে পড়া ট্যাবু রক্ষিত শিক্ষিত মানুষদের বেশিরভাগের সেক্স এডুকেশন প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ের । অনেকে তাদের সেক্স এন্ড রিলেশনশিপের অনেক প্রব্লেম শেয়ার করতে গিয়ে নিজেরাই সেলফ ডায়াগনোসিস করে বলে বসছে – তাদের এই সমস্যাগুলো মাস্টারবেশন থেকে । মনে হলো – বিষয়টি সহজ করে বলা উচিত মানুষগুলোর জন্যে ।
সেক্স মানে স্পর্শ । শরীরের স্পর্শ । এই স্পর্শের খেলা এতটাই শক্তিশালী যে, মনে মনে ভাবলেও শরীরে সে খেলার আনন্দ পাওয়া যায় । বেশিরভাগ মাস্টারবেশন আসলে এই স্পর্শ এবং ফ্যান্টাসির একটি সমন্বয় গেইম ।
সেক্সকে দু ভাগে ভাগ করা যায় । সেলফ সেক্স এবং পার্টনার সেক্স । পার্টনার সেক্সকে পিনারট্রেটিভ সেক্সও বলা যায়, সেলফ সেক্সকে নন পিনারট্রেটিভ বা টাচ সেক্স বলা যায় । দুটোর পরিণতি একই – অর্গাজম এবং ইজাকুলেশন । বাই প্রোডাক্ট হিসাবে আসে স্পার্ম ওভামের মিলনের মাধ্যমে নিউ প্রোডাক্ট ।
সেক্স মানে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া নয় । সেক্স হচ্ছে আমাদের সোশ্যাল ইন্টারেকশনের ফিজিক্যাল কমিউনিকেশন । বাই প্রোডাক্ট হিসাবে রিপ্রোডাকশন আসে । মনে রাখতে হবে – ফিজিক্যাল মেন্টালের বাহিরে আমরা সোশ্যাল এনিমেল ।
এই সেলফ সেক্স হলো মাস্টারবেশন । অন্য ভাবে বললে সেলফ প্লেজার ।
প্রথমে আসি – মাস্টারবেশন গিলটি ফিলিংস নিয়ে । মাস্টারবেশন ইস নট এ ক্রাইম । তাহলে এটি নিয়ে দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগার কিছু নেই । আপনি আপনার শরীরের একটি অংশকে স্পর্শ করে আনন্দ পাচ্ছেন, ব্যাপারটাকে এ ভাবে দেখলেই হয় । মাঝে মাঝে নিজেরা নিজেদের আঙুলের মটকা ফুটাতেও ভালো লাগে । এই আঙুলের মটকা কিছুই নয় । আমাদের হাড়ের জয়েন্টকে একটা আরেকটার সাথে ঘষা দিলে ভালো লাগে । তখন লোকাল নার্ভ গুলোতে কিছু হরমোন সিক্রেট হয়, আমাদের ভালো লাগে । এখন আপনার ভালো লাগে আঙুলে আঙুলে স্পর্শ করে, এটা কি অপরাধ ! একই হাত বা আঙ্গুল দিয়ে আপনি শরীরের একটি অংশ স্পর্শ করছেন, এতে আপনি ভালো ফিল করলে কার কি আসে যায় । সুতরাং ভেবে নেবেন – সিঙ্গেল হন, বিবাহিত হন, কিশোর হন, বুড়ো হন, মাস্টারবেশন সেক্সের একটা প্লেজার আর্ট, এটায় গিলটি ফিল করার কিছু নেই, এটা আনন্দের, এটা উপভোগের এবং এটা আপনার প্রাইভেট পার্সোনাল রাইটস । যারা মাস্টারবেশনকে অপরাধতুল্য করে ছড়ায়, তারা আসল ক্রিমিনাল । মাস্টারবেশনের সাথে বয়স, জেন্ডার, মেরিটাল স্টাটাস এসবেরও কোনো সম্পর্ক নেই ।
মাস্টারবেশনের মেডিক্যাল সাইডটি নিয়ে বড়ো পরিসরে লিখবো । ছোট করে আজ বলি – নিয়মিত মাস্টারবেশন শরীরের কোনো ক্ষতি তো দূরের কথা, উল্টো লাভ করে । মাস্টারবেশন শরীরে ক্যালোরি বার্ন করে, ইমমিউনিটি বাড়ায়, ব্লাড প্রেশার কমায়, উদ্বিগ্নতা এবং স্ট্রেস কমায়, ডিপ্রেশন থেকে বের করে, ভালো ঘুম আনে, ক্ষুধা বাড়ায় । নিয়মিত মাস্টারবেশন পেশাপের রাস্তাকে জীবাণু মুক্ত রাখে, নিয়মিত মাস্টারবেশন মস্তিষ্কে লাভ হরমোন অক্সিটোসিন এবং ডোপামিন সিক্রেট করে, যা আমাদের হেলথ বেনিফিট থেকে সোশ্যাল কমিউনিকেশন বাড়ায়, কাজে ফোকাস তৈরী করায় । পুরুষদের সবচেয়ে বেশি হয় প্রোস্টেট ক্যান্সার । প্রতি পাঁচ জন পুরুষের একজনের প্রোস্টেট ক্যান্সার হয় । নিয়মিত মাস্টারবেশন এই প্রোস্টেট ক্যান্সারের হার এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেয় । এ নিয়ে আরেকটি উল্টো কথা আছে । হাই সেক্স ড্রাইভ লিবারেট না করতে পারলে প্রোস্টেট ক্যান্সারের সম্ভাবনা এক তৃতীয়ংশ বেড়ে যায় । মাস্টারবেশন দুটোকেই সমাধান করে ।
পিরিয়ড টাইমে মাস্টারবেশন মেয়েদের পিরিয়ড পেইন অনেকাংশে কমিয়ে দেয় । এমনকি নিয়মিত মাস্টারবেশন পিরিয়ডের সময় পেইন কম আনায় ।
পঞ্চাশের আগে নিয়মিত মাস্টারবেশন ডায়াবেটিসের আর্লি দেখা দেয়াকে ডিলে করে । মাস্টারবেশন নির্ঘুমতার নির্মম ওষুধ ।
এক গবেষণায় দেখা গেছে আঠারো বছরের মধ্যে ৮৪% পুরুষ এবং ৫৬% নারী, নিয়মিত মাস্টারবেট করেন । বাকি জীবনে সেটা গিয়ে থেকে ৯২% পুরুষ এবং ৭০ ভাগ নারী । আরও মজার হলো অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, গোপনে হোক আর দুজনে জানার মধ্যে হোক, ৬৪% দম্পত্তি মাঝে মাঝে মাস্টারবেট করেন । মাস্টারবেশন পঞ্চাশ ভাগ মেয়েদের প্রিয় পছন্দ টয়, বাকি পঞ্চাশ ভাগ ভুজ ! ছেলেদেরও মাস্টারবেশনের টয় আছে । মেয়েদের প্রায় ৩০০ ধরনের খেলনা আছে, তবে ছেলেদের সেই তুলনায় কম । বছরে ৮ মিলিয়ন ছেলেদের মাস্টারবেশন টয় ফ্ল্যাশ টিউব বিক্রি হয় । সেক্স টয়েজের গ্লোবাল মার্কেট বছরে 60 বিলিয়ন ডলার ।
বেশিরভাগ পুরুষের মাস্টারবেশন করে এজাকুলেট হতে সর্বনিম্ন পাঁচ সেকেন্ড থেকে পাঁচ মিনিট । নারীর সেটা দ্বিগুন সময় লাগে ।
একটা কথা আছে – when it comes to sex and pleasure, there is no normal.
© অপূর্ব চৌধুরী । চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক । জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড । গ্রন্থ ৮ । উল্লেখযোগ্য বই : অনুকথা, জীবন গদ্য, ভাইরাস ও শরীর ।
Leave a Reply