লিখেছেন- আসিফ মহিউদ্দীন
প্রাচীন মহাকাব্যগুলো এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ছিল ব্যাক্তিনির্ভর। প্রবল ব্যাক্তিপুজায় আসক্ত এবং ব্যাক্তিবিশেষকে বীরে পরিণত করার জন্যেই সেগুলো লিখিত হতো। সে সময়ের শাসক, রাজা বাদশারা বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সম্পদশালী করে দিতো নিজেকে ইতিহাসে ঢুকিয়ে দেবার জন্য। যেই রাজা বাদশা যতবড় সাহিত্যিক, যতবড় ইতিহাস রচনাকারী কিনতে পেরেছে, যত অর্থ ব্যয় করে অট্টালিকা বানাতে পেরেছে, সে ইতিহাসে হয়ে উঠেছে ততবড় মহামানব। কিন্তু সম্পদশালী হবার জন্য সে কত মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে, তার হদিস ইতিহাসে নাই।
তাই প্রাচীন ইতিহাসগুলো এবং সাহিত্যসমূহ শুধুমাত্র হয়ে উঠেছে শাসকের ইতিহাস। কোন রাজা কোন রাজাকে খুন করেছে, কার ভাই ষড়যন্ত্র করে কোন রাজাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে, ইতিহাস হিসেবে আমাদের সেসবই পড়ানো হয়। বরঞ্চ বলা ভাল, গেলানো হয়। কিন্তু সেই সময়ের সাধারণ মানুষের ইতিহাস কোথায়?
আমরা মিশরের মিরামিড তৈরির ইতিহাস জানি, তাজমহল তৈরির ইতিহাস জানি, সে সময়কালের রাজাদের শৌর্যবীর্যের কথা লোকমুখে আজও শুনতে পাই, কিন্তু সেই সময়ের সেই সব দাসের ইতিহাস কোথায়, যারা এগুলো তৈরি করেছিল?
পিরামিড, তাজমহল বা কোন সাম্রাজ্য কোন ব্যাক্তিবিশেষ তৈরি করে না। এর পিছনে লুকিয়ে ছিল লক্ষ মানুষের ঘাম এবং রক্ত। সেই রক্তের ইতিহাস কোথায়? সেই ঘামের ইতিহাস কোথায়? লক্ষ লক্ষ দাসের ইতিহাস এক লাইনেই কি শেষ হয়ে যাবার মত তুচ্ছ ঘটনা?
প্রথাগত ইতিহাসচর্চার যেই ধারণা রয়েছে, তাতে একটা বড় ধাক্কা দেয় নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা গোষ্ঠী। পুর্ববর্তী সকল ইতিহাস চর্চার জন্মই পাশ্চাত্যে, আমাদের এখন পর্যন্ত যত ইতিহাস শেখানো হয় সবই পাশ্চাত্যের ছকে তৈরি করা, পাশ্চাত্যের চোখে আমাদেরকে দেখার জন্য নির্মিত ইতিহাস। নিম্নবর্গের ইতিহাস আবেগ নির্ভর নয়, জাতীয়তাবাদ নির্ভর নয়, একটি তাত্বিক এবং যৌক্তিক ইতিহাস নির্মাণ।
আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে উঠবে আধুনিক মননশীল ইতিহাস, মানবিক ইতিহাস, যেখানে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের কথা থাকবে, তাদের গৌরবের কথাই শুধু না, তাদের বেদনার কথা, লাঞ্ছনার কথা, তাদের স্বজন হারানোর অনুভূতি থাকবে।
কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে উঠছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতার শৌর্যবীর্যের ইতিহাস, খুন ধর্ষণ লুন্ঠনের ইতিহাস। কে কোথায় গ্রেফতার হয়েছে, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে, সেসব গুরুত্বপুর্ণ বটে, কিন্তু সামগ্রিক ইতিহাসের একটা অংশ মাত্র। সেখানে সাধারণ মানুষের কথা কোথায়? মানুষের ঘামের কথা কোথায়?
আওয়ামী পন্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানেই শেখমুজিবের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের নেতাদের ইতিহাস। আর বিএনপি পন্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানেই শহীদ জিয়া, কালুরঘাট এবং বেতার কেন্দ্র না থাকলে যেন মুক্তিযুদ্ধই হতো না! আর জামাতের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে গৃহযুদ্ধ বা শুধুই গন্ডগোল।
আর এই তিন ঘরানার ভাড়াটে লেখক, ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিকের রচনাতেও তাই শুধুই সেই সব নেতারই প্রশংসাবাক্য। পুরো ইতিহাস জুড়েই নেতাদের কথা, নেতারা কোথায় খেয়েছেন, কোথায় হেগেছেন তার পুংখানুপুংখ বিবরণ না দিলে যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অপুর্ণ রয়ে যাবে। আর যারা নেতাদের কথা লেখেননি, তারা লিখেছেন নিজেকে বীর বানাবার মিথ্যা ইতিহাস, কারো কারো লেখা পড়লে মনে হয়েছে, সে একাই পুরো পাক বাহিনীকে পিটিয়ে লাল করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরের বাঙলাদেশের ইতিহাস হয়ে উঠেছে কয়েকটি কুকুরের ক্ষমতার কোন্দল, ক্যু আর রাজনৈতিক হত্যার ইতিহাস। কিন্তু সেই সময়ের মানুষের কথা কোথাও বলা হয় নি, কোথাও লেখা হয় নি। মুক্তিযুদ্ধ ছিল গনমানুষের অধিকার আদায়ের যুদ্ধ, তা ক্রমশ হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্তের জাতীয়তাবাদী আবেগ নির্ভর কিছু বুলি, রাজনৈতিক দলের স্লোগান-ভাষণ আর কাউকে একমাত্র নায়ক বানাবার হাস্যকর চেষ্টা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ফলে ক্ষমতা শুধু একদল বিদেশি শাসকের কাছ থেকে আরেকদল দেশীয় শাসকের কাছেই গেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পেয়েছে কিছু আবেগধর্মী গান, দেশাত্মবোধক সাহিত্য আর নিম্নবিত্তরা যেরকম ছিল সেভাবেই রয়ে গেছে। যদিও ত্যাগ স্বীকারের সবটুকুই তাদেরই করতে হয়েছিল।
ইতিহাসের কোন জাতীয়তা থাকতে পারে না, কোন পক্ষপাত থাকতে পারে না। ইতিহাস হতে হবে নির্মোহ, নিরপেক্ষ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সকল ইতিহাসই সর্বদাই বিকৃত। কেউ কেউ বিকৃত ইতিহাসের বিপক্ষে সঠিক ইতিহাস নাম দিয়ে শুধু আরেকটা বিকৃত ইতিহাসই উপস্থাপন করেন মাত্র।
Leave a Reply