(এমন বাঙালির সংখ্যা নগণ্য, যারা আজীবন নাস্তিক। অধিকাংশ নাস্তিককে বেরিয়ে আসতে হয় ধর্মশৃঙ্খলের কঠোর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে। দুর্গম সে পথ, তাই কাজটি দুরূহ। নূরের পথ ছেড়ে আলোর পথে আসার এই কাহিনীগুলো অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো গতানুগতিক, তবে প্রতিটি কাহিনীরই আছে কিছু স্বকীয়তা, আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাই এই কাহিনীগুলো সব সময়ই কৌতূহলোদ্দীপক, উপভোগ্য, উদ্দীপনাজাগানিয়া ও অনুপ্রেরণাদায়কও বটে।
কী ভালোই না হতো, যদি ধর্মকারীর পাঠক-লেখকদের মধ্যে যাঁদেরকে পাড়ি দিতে হয়েছে এই পথ, তাঁরা তাঁদের ধর্মত্যাগের সেই কাহিনী স্বনামে-বেনামে-ছদ্মনামে লিখে বাকিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন – বিশদভাবে, সংক্ষেপে বা কয়েক ছত্রে!
কেউ কেউ হয়তো আগে কোথাও লিখে প্রকাশ করেছেন তাঁদের এই কাহিনী। সেগুলোও আসুক; এখানকার পাঠকরাও পড়ুক সেসব। তারপর সব লেখার সংকলন ধরে রাখা হবে ইবুক আকারে।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dhormockeryঅ্যাটgmail.com অথবা ধর্মপচারকের ইনবক্স।)
লিখেছেন জগৎপ্রেমিক
আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক সীমাবদ্ধ জীবন যাপন করতাম। আমার পিতা স্কুলের প্রতি যতটা গুরুত্ব দিতেন, ততটাই দিতেন ধর্মীয় শিক্ষায়। ক্লাস ওয়ান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার আইন
জারি করে দেন। তাই হলো।
বলে রাখি, আমি পশু-পাখি অনেক পছন্দ করি। তো ক্লাস টু-তে জিলা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পেয়ে আমার গুরুত্ব কমে যায়। তাই আমার প্রতি আগের মত নজরদারি করা হত না। বাইরে যেতে শুরু করলাম নিয়মিত। একসময় সমবয়সীদের সাথে কুকুর পালা শুরু করলাম।
কিন্তু একদিন যে-হুজুর আমাকে পড়াতো, সে দেখে ফেললো। পরদিন এসেই ঝাড়ি, আজ পড়াবো না, কাল আসবো, গোসল করে পাক কাপড়চোপড় পরে রেডি হয়ে থাকবে। আমি সাতপাঁচ না ভেবে তা-ই করলাম। পরদিন বাবা-মার উপস্থিতিতেই যা বলল, তার সারমর্ম, ”কুকুর অনেক নাপাক একটা প্রাণী। কুরান-হাদিসে কুকুর থেকে পবিত্র থাকার নির্দেশ আছে। যে বাড়িতে কুকুর থাকে, সে বাড়িতে ফেরেশতা আসে না। হুজুরের কোন পীরের বংশ, হুজুর হাফেজ, তাই সর্বদা পাক থাকতে হয়। কুকুর ছুঁয়ে আমি নাপাক হয়ে যাই। এরকম হলে আমাকে পড়াবে না।”
বাসা থেকে কড়া নজরের মাঝে জীবনযাপন করা শুরু হল। খুব কষ্ট পেলাম। তবুও লুকিয়ে চালিয়ে গেলাম। কিন্তু অপরাধবোধে ভুগতাম, আল্লাহ তো দেখছে! একদিন হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম: কুকুর কেন এত নাপাক জীব?
হুজুর: এরা ময়লা খায়।
আমি: বিড়ালও তো খায়, কিন্তু বিড়াল নাকি মহানবীর পছন্দ ছিল?
হুজুর: কুকর পায়খানা খায়। বিড়াল খায় না, বিড়াল পবিত্র প্রাণী।
আমি: হুজুর, আমার কুকুরগুলোকে আমি দেখে রাখি, ময়লার ধারের কাছেও যেতে দেই না, একদিন পর পর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাই। তাহলে তো সমস্যা নাই।
হুজুর: তা হবে না। কুরান-হাদিসে এসব বলা নাই। তুমি আবার কুকুর ছানা শুরু করছ?
আমি: না, হুজুর, সম্ভাবনার কথা বলছিলাম।
মনে বিদ্বেষের বীজ গজিয়ে গেল। আমি কুকুর এত পছন্দ করি, কিন্তু আল্লাহর তা পছন্দ না! তবে সৃষ্টি করেছেন কেন! কথাটা আরেকদিন হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, আল্লার ইচ্ছা।
অকাট্য যুক্তি। আল্লার এ ইচ্ছার পিছনে যুক্তি কী? এটা জিজ্ঞেস করলাম না। কিন্তু ভাবতে লাগলাম। আল্লার আদেশের পেছনে কারণ কী?
নাহ, ইবলিশ ধরেছে, কাফেরী চিন্তা আসছে। তওবা করে বিসমিল্লাহ, আয়েতুল কুরসি পড়ে তালি-তুলি দিলাম। কিন্তু এসবে কি আর চিন্তা থেমে থাকে? যে চিন্তা করতে চায়, তাকে কেউ ফেরাতে পারবে না। যার ফলে দিনে দশ-বারো বার করে তওবা করা লাগতো। একদিন বুঝলাম, আমাকে তো ইবলিশ গ্রাস করে ফেলেছে। হুজুরকে বললাম, হুজুর আমাকে তো ইবলিশে ধরে।
হুজুর ফু টু দিয়ে কী কী জিকির লিখে দিয়েছিল। কিন্তু কিসের জিকির? আমার মন পড়ে আছে আমার কুকুরগুলোর কাছে। একদিন ভাবলাম, আমার ভাগ্য তো আল্লার হাতেই, ইবলিশ ধরা ভাগ্যে থাকলে কিছু করার নেই।
এ ধরনের কনফিউশনে ৫ বছরের নামাজের অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেল। কৌশলে হুজুরকে বাদ দেওয়ালাম। আব্বুকে বললাম, সব শিখে ফেলেছি, এখন থেকে কুরান নিজে নিজেই পড়তে পারবো।
আব্বু উলটো খুশি হল। হুজুর বাদ হয়ে গেল আর ইসলামিক বইয়ের সাপ্লাই বেড়ে গেল। এক সময় আব্বু কিছু ইংরেজি অনুবাদকৃত বইও কিনে দিল। তার মাঝে একটি ছিল ‘A Breif History of Time’ by Stephen William Hawking বঙ্গানুবাদ। প্রথম দিকে দুই পাতা পড়ে মাথায় পানি ঢালতাম। অপরদিকে জাফর ইকবালের কিছু বই পড়ে বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাবিশ্বের প্রতি কৌতূহল বাড়তে লাগলো। একদিন আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করার সময় ”A Breif History of Time”-এর কথা উঠে এলো।
এবার আমার কৌতূহল ঠিক মত জাগল, প্রকৃত আগ্রহে পড়তে লাগলাম। জানি না, কী বুঝতে কী বুঝেছিলাম, আমার মনে হল, ঐ বইটি কুরানের চেয়েও দামী। এরপর যাকেই পাই, তার সঙ্গেই এ বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। সাত আকাশ, জান্নাতের অবস্থান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। লক্ষ্য করলাম, আলেমরাও এসব সম্পর্কে অজ্ঞ। তখন দুই ধরনের মানুষ পেলাম:
১. হুজুর, যারা ধর্ম বোঝে, কিন্তু বিজ্ঞান বোঝে না।
২. আত্মীয়স্বজন, এরা বিজ্ঞান কিছুটা বোঝে, কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে আমার চেয়ে কম জানে।
কিন্তু আমার ১ ও ২ এর সমন্বিত উত্তর চাই। যদি কুরান সকল জ্ঞানের আধার হয়, তবে আলেমরাই তাই। কিন্তু তারা ব্যর্থ। উত্তর পেলামই না। কিছুতেই পেলাম না। সেরকম কেউ ছিলও না। ছেলেমানুষী মন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। কবে যে বুঝলাম, এ ধর্ম না মানলেও চলবে, তা সঠিক জানি।
এর পর কতিপয় বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির কাছ থেকে বই ধার করে নিয়ে পড়তে লাগলাম। এ থেকেই সাহিত্য, কাব্য, ধর্ম, বৈজ্ঞানিক, সায়েন্সফিকশন, কাল্পনিক সব ধরনের বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম।
এর পরের কাহিনী সবার মতই।
Leave a Reply