লিখেছেন গোলাপ
স্বঘোষিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রচারিত বাণীতে অবিশ্বাসীরা কেন “সন্দেহ পোষণ” করতেন তার বিশদ আলোচনা আগের দু’টি পর্বে করা হয়েছে। মুহাম্মদেরই জবানবন্দীর (কুরান) আলোকে যে সত্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট, তা হলো, স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) কুরাইশ/অবিশ্বাসীদের তিনটি মূল অভিযোগের কোনোটিরই সদুত্তর দিতে পারেননি। মুক্তচিন্তার পাঠকরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন যে অবিশ্বাসীদের অভিযোগগুলো ছিল যথার্থ! তাদের প্রত্যেকটি অভিযোগেরই যে সুনির্দিষ্ট কারণ আছে তা স্বয়ং মুহাম্মদেরই চারণকৃত আত্মজীবনীগ্রন্থের (কুরানে) পর্যালোচনায় অত্যন্ত সুস্পষ্ট! মুহাম্মদ যে মাঝে মধ্যেই অস্বাভাবিক আচরণ করতেন সে সত্যটিও কুরান-সিরাত-হাদিসের আলোকে আজ প্রমাণিত। শারীরিক এবং/অথবা মানসিক অসুস্থতার কারণে মাঝে মধ্যেঅস্বাভাবিক আচরণ করলেও জীবনের অধিকাংশ সময়ই মুহাম্মদ যে সুস্থ-সবল দেহ মনের অধিকারী ছিলেন, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায় (বিস্তারিত দ্বাদশ পর্বে)।
অবিশ্বাসীদের এহেন সন্দেহ ও অভিযোগের জবাবে আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রবক্তা মুহাম্মদ (আল্লাহ) যে সকল কলাকৌশল অবলম্বন করেছিলেন তা ছিল মূলত: চার প্রকার:
১) দিয়েছেন কৈফিয়ত। তারপর
২) করেছেন নিজেরই ভূয়সী প্রশংসা। অতঃপর
৩) হুমকি ও প্রলোভন। এবং
৪) প্রতিদ্বন্দ্বিতা আহ্বান
১) আত্মপক্ষ সমর্থনে মুহাম্মদের (আল্লাহ) কৈফিয়ত!
মুহাম্মদের (আল্লাহ) ভাষায়,
৫২:২৯-৩০– অতএব, আপনি উপদেশ দান করুন। আপনার পালনকর্তার কৃপায় আপনি অতীন্দ্রিয়বাদী নন এবং উম্মাদও নন। তারা কি বলতে চায়: সে একজন কবি আমরা তার মৃত্যু-দুর্ঘটনার প্রতীক্ষা করছি।
মুহাম্মদ উম্মাদ নন
৬৮:২ – আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে আপনি উম্মাদ নন।
মুহাম্মদের বাণী শয়তানের উক্তি নয়
৮১:২২–২৫ – – তোমাদের সাথী পাগল নন। তিনি সেই ফেরেশতাকে প্রকাশ্য দিগন্তে দেখেছেন। তিনি অদৃশ্য বিষয় বলতে কৃপণতা করেন না। এটা বিতাড়িত শয়তানের উক্তি নয়।
২) তারপর, নিজেরই ভূয়সী প্রশংসা!
মুহাম্মদের (আল্লাহ) ভাষায়,
মুহাম্মদ মহান চরিত্রবান
৬৮:৩-৪ – আপনার জন্যে অবশ্যই রয়েছে অশেষ পুরস্কার। আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।
মুহাম্মদ বিশ্ববাসীর রহমত
২১:১০৭ – আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।
মুহাম্মদ উজ্জ্বল প্রদীপসম
৩৩:৪৫-৪৬ – আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।
মুহাম্মদ সমগ্র মানবজাতির সুসংবাদাতা
৩৪:২৮ – আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতাও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।
মুহাম্মদ আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাশালী-সবার মান্যবর-বিশ্বাসভাজন
৮১:১৯-২১ -নিশ্চয় কোরআন সম্মানিত রসূলের আনীত বাণী, যিনি শক্তিশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাশালী, সবার মান্যবর, সেখানকার বিশ্বাসভাজন।
সৃষ্টিকর্তা নিজে মুহাম্মদের প্রতি করেন রহমত প্রেরণ
৩৩:৫৬ – আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণকরেন।
>>> আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির এই যুগে আধুনিক চিকিৎসকরা পরিপার্শ্বের জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে মুহাম্মদের মত “এহেন Special” দাবীদারদের জরুরী ভিত্তিতে (Psychiatric emergency) মানসিক হাসপাতালের তালাবন্ধ কক্ষে ভর্তি করেন।
৩) অত:পর, যথারীতি হুমকি ও প্রলোভন!
মুহাম্মদের (আল্লাহ) ভাষায়,
৮৪:২০–২৫ – অতএব, তাদের কি হল যে, তারা ঈমান আনে না? যখন তাদের কাছে কোরআন পাঠ করা হয়, তখন সেজদা করে না। বরং কাফেররা এর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তারা যা সংরক্ষণ করে, আল্লাহ তা জানেন। অতএব, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।
৪) এবং, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আহ্বান (Challenge)
মুহাম্মদের (আল্লাহ) ভাষায়,
২: ২৩ -এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস| তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নাও–এক আল্লাহ্্কে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো|
১০:৩৮ – মানুষ কি বলে যে, এটি বানিয়ে এনছে? বলে দাও, তোমরা নিয়ে এসো একটি সূরা, আর ডোকে নাও, যাদরেকে নিতে সক্ষম হও আল্লাহ ব্যতীত, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।
১১:১৩– তারা কি বলে? কোরআন তুমি তৈরী করেছ? তুমি বল, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরী করে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও, যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে।
১৭:৮৮ – বলুনঃযদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয়, এবংতারাপরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতেপারবে না।
৫২: ৩৩–৩৪ – না তারা বলেঃ এই কোরআন সে নিজে রচনা করেছে? বরং তারা অবিশ্বাসী। যদি তারা সত্যবাদী হয়ে থাকে, তবেএর অনুরূপ কোন রচনা উপস্থিত করুক।
>>> মুহাম্মদের বর্ণিত স্রষ্টা (আল্লাহ) তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের বাসনায় তার অস্তিত্বে অস্বীকারকারীদের সাথে “সূরা প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ” জানিয়েছেন! কম পক্ষে ৫ বার! এ কোন স্রষ্টা যে তার অস্তিত্বে অস্বীকারকারীদের সাথে সুরা প্রতিযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছেন?
প্রবক্তা কি জানতেন যে আমাদের এই দৃশ্যমান জগতটিই৯৩০০ কোটি আলোক-বর্ষ পরিবৃত একটি স্থান? (এক আলোক বর্ষ = ছয়শ হাজার কোটি (Six Trillion) মাইল)
প্রবক্তা কি জানতেন যে আমাদের এই জগতটি হতে পারে অনন্ত-মহাবিশ্বের (Multiverse) কোটি কোটি অনুরূপ মহাবিশ্বের একটি?
প্রবক্তা কি জানতেন যে এ ছাড়াও আছে অদৃশ্যমান জগত: অণু, পরমাণু, কোয়ার্ক, কোষ-DNA/RNA, ডার্ক ম্যাটার – ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি?
প্রবক্তা কি জানতেন যে মানুষের এই আবাসস্থলটি অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি স্থান?
প্রবক্তা কি জানতেন যে মানুষ নামের এই প্রজাতিটিবর্তমানে জীবিত দৃশ্যমান ১৭ লক্ষ প্রজাতির একটি? এ ছাড়াও আছে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার অদৃশ্য জগৎ?
তিনি কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে যে-মানুষের সাথে সে “প্রতিযোগিতার” আহ্বান জানাচ্ছেন তার উদ্ভব হয়েছে মাত্র দুই লক্ষ বছর আগে? বিশ্বসৃষ্টির ১৩৫০ কোটি বছর পরে? আর তারা কবিতা লেখা শুরু করেছে সামান্য কয়েক হাজার বছর আগে?
এ তথ্যগুলোর যে কোনো একটির সঠিক জবাব জানা থাকলে মানুষের সাথে “প্রতিযোগিতা” আহ্বানের আগে তিনি নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতেন!
এই সুবিশাল চমকপ্রদ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদৌ কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে, এমন কোনো প্রমাণ নাই। আধুনিক বিজ্ঞান নিশ্চিত করছে যে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই (Fundamental laws of Nature) তথাকথিত কোনো স্রষ্টার হস্তক্ষেপ ছাড়াই একদম “শূন্য (নেই) থেকে” এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব হতে পারে। এর পরেও যদি কোনো ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়ে অপরের জীবনযাত্রা প্রণালীর ওপর কোনোরূপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কটাক্ষ-তাচ্ছিল্য-অসম্মান-অসুবিধা-হুমকি বা হস্তক্ষেপ না করে একান্ত ব্যক্তিগত স্বস্তি ও সুখ পেতে চান, তবে তাঁকে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু যদি তিনি দাবী করেন যে এই অনন্ত মহাবিশ্বের স্রষ্টা (যদি থাকে) তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উগ্র বাসনায় অবিশ্বাসীদের সাথে “জাতীয় বা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট” সাদৃশ্য প্রতিযোগিতায় (যেমন, বাংলাদেশে ক্লোজ-আপ ওয়ান বা চ্যানেল আইয়ের সঙ্গীত প্রতিযোগিতা অথবা World cup football/cricket/heavy weight champion) অংশ নিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকারকারীদের সমুচিত জবাব দিতে চান!। অথবা তিনি যদি ঘোষণা দেন যে বিশ্বস্রষ্টা আকাশ থেকে তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের শায়েস্তা করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের কুচক্রী শাসক/রাজনীতিবিদদের মত পাঠান লাঠি-সোঠা-চাকু-ছুরি-পিস্তল-মেশিন গান সজ্জিত খুনী ক্যাডার বাহিনী, তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি তা হলো, এরূপ ব্যক্তি হয় এই মহাবিশ্বের বিশালতা বিশয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, এবং/অথবা মানসিক ভারসাম্যহীন! না, মুহাম্মদ (আল্লাহ) কোন “সংগীত প্রতিযোগিতার” আহ্বান জানাননি; জানিয়েছেন “সুরা প্রতিযোগিতার” আহ্বান! তিনি কোনো “পিস্তল-মেশিন গান” সজ্জিত ক্যাডার বাহিনী পাঠান নাই; পাঠিয়েছেন “ঢাল-তলোয়ার”সজ্জিত ফেরেশতাকুল! [সুরা আনফাল: ৮:৯, ৮:১২-১৭]
প্রায় সমকক্ষ না হলে কেউ কারো কাছেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানায় না। একজন শক্তিমান মানুষ কখনোই তার শক্তিমত্তায় অস্বীকারকারী পিপীলিকাকে (কিংবা অত্যন্ত দুর্বল কোনো মানুষকে) তার সাথে শক্তিমত্তা প্রতিযোগিতার আহবান জানাবেন না! জগৎশ্রেষ্ঠ কোনো বিজ্ঞানী তাকে অস্বীকারকারী অশিক্ষিত কৃষকের কাছে বিজ্ঞান প্রতিযোগিতার আহ্বান জানবেন না! কিংবা বিখ্যাত কোনো কবি কখনোই তার অস্বীকারকারী অর্বাচীন শিশুর কাছে কবিতা প্রতিযোগিতার আহ্বান জানবেন না! সমকক্ষ জ্ঞান না করলে এমন আচরণ কি কেউ করতে পারেন? যদি করেন, তবে তা যে তার মস্তিষ্ক বিকৃতিরই উপসর্গ এ ব্যাপারে আদৌ কি কোনো সন্দেহের অবকাশ আছে?
প্রবক্তা মুহাম্মদ যদি মস্তিষ্ক বিকৃত না হোন তবে আমাদের মানতেই হবে যে তাঁর বর্ণিত স্রষ্টা মানুষেরই সমকক্ষ। কে সেই “আল্লাহ”?সে “আল্লাহ তিনি নিজেই! মুহাম্মদ বিন আবদ-আল্লাহ! কারণ, মুহাম্মদই সেই পুরুষ যে বার বার তাকে অস্বীকারকারীর সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সুরা প্রতিযোগিতার আহবান জানিয়েছেন? কারণ, মুহাম্মদই সেই পুরুষ যে তার পরিপার্শ্বের মানুষের স্বীকৃতি লাভের চেষ্টায় ছিলেন মরিয়া!এতটায় মরিয়া যে যে-কোনো মূল্যে তাঁর তা চাইই চাই! হুমকি-ধমকি-প্রলোভন-শাস্তি ইত্যাদি এমন কোনো পন্থা নেই যা তিনি তার পরিপার্শ্বের মানুষের ওপর প্রয়োগ করেননি!
মুমিনদের সন্দেহ
এখন দেখা যাক সমসাময়িক বিশ্বাসী মুসলমানেরা প্রবক্তা মুহাম্মদের বাণীগুলোকে নিঃসন্দেহে পালন করতেন কি না। কুরান–সিরাত–হাদিস সাক্ষ্য দেয় যে বিশ্বাসীদেরও অনেকে মুহাম্মদের আদেশ নিষেধকে পালন করতেন না। যাদের অনেককে মুনাফিক নামে আখ্যায়িত করা হয়। প্রবক্তা মুহাম্মদ (আল্লাহ) তাদেরকে উজ্জীবিত করার জন্য যথারীতি প্রলোভন, হুমকি–শাসানী কিছুই বাদ রাখেননি। অল্প কিছু উদাহরণ:
মক্কায়:
৬১:৭ – যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহুত হয়েও আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে; তার চাইতে অধিক যালেম আর কে? আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।
৭৪:৩১ – আমি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যেই তার এই সংখ্যা করেছি–যাতে কিতাবীরা দৃঢ়বিশ্বাসী হয়, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবীরা ও মুমিনগণ সন্দেহ পোষণ না করে এবং যাতে যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারা এবং কাফেররা বলে যে,আল্লাহ এর দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছেন। এমনিভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথেচালান। আপনার পালনকর্তার বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন এটা তোমানুষের জন্যে উপদেশ বৈ নয়।
মদিনায়:
৪: ৬৬ – আর যদি আমি তাদের নির্দেশ দিতাম যে, নিজেদের প্রাণ ধ্বংস করে দাও কিংবা নিজেদের নগরী ছেড়ে বেরিয়ে যাও, তবে তারা তা করত না; অবশ্য তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন| যদি তারা তাই করে যা তাদের উপদেশ দেয়া হয়, তবে তা অবশ্যই তাদের জন্য উত্তম এং তাদেরকে নিজের ধর্মের উপর সুদৃঢ় রাখার জন্য তা উত্তম হবে|
৮:৫ – যেমন করে তোমাকে তোমার পরওয়ারদেগার ঘর থেকে বের করেছেন ন্যায় ও সৎকাজের জন্য, অথচ ঈমানদারদের একটি দল (তাতে) সম্মত ছিল না|
৯:৩৮–৩৯ – হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি হল, যখন আল্লাহর পথে বের হবার জন্যে তোমাদের বলা হয়, তখন মাটি জড়িয়ে ধর, তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনেপরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প। যদি বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদের মর্মন্তুদ আযাব দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। তোমরা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আরআল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।
৩৩:১০–১৩ – যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চ ভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন তোমাদেরদৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে। সে সময়ে মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিল। এবং যখন মুনাফিক ও যাদের অন্তরে রোগ ছিল তারা বলছিল, আমাদেরকে প্রদত্ত আল্লাহ ও রসূলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা বৈ নয়। এবং যখন তাদের একদল বলেছিল, হে ইয়াসরেববাসী, এটা টিকবার মত জায়গা নয়, তোমরা ফিরে চল।তাদেরই একদল নবীর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বলেছিল, আমাদের বাড়ী–ঘর খালি, অথচ সেগুলো খালি ছিল না, পলায়ন করাই ছিল তাদের ইচ্ছা।
৪৭:২০-২৩ – যারা মুমিন, তারা বলেঃ একটি সূরা নাযিল হয় না কেন? অতঃপর যখন কোন দ্ব্যর্থহীন সূরা নাযিল হয় এবং তাতে জেহাদের উল্লেখ করা হয়, তখন যাদের অন্তরে রোগ আছে, আপনি তাদেরকে মৃত্যুভয়ে মূর্ছাপ্রাপ্ত মানুষের মত আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখবেন। সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্যে। তাদের আনুগত্য ও মিষ্ট বাক্য জানা আছে। অতএব, জেহাদের সিন্ধান্ত হলে যদি তারা আল্লাহর প্রতি পদত্ত অংগীকার পূর্ণ করে, তবে তাদের জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে। এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদেরকে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।
৪৯:১৫ – তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।
প্রবক্তা মুহাম্মদেরও সন্দেহ
আর প্রবক্তা মুহাম্মদ? তাঁর কী খবর? হ্যাঁ, মুহাম্মদ নিজেও ছিলেন “সন্দেহভাজনদের একজন”! ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মাঝে মাঝে তিনি নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। হারিয়ে ফেলতেন মনোবল। পরক্ষণেই আবার নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতেন তাঁর সৃষ্ট আল্লাহর নামে। করতেন স্বগতোক্তি! নিচের আয়াতটি তার সাক্ষ্য হয়ে আছে!
১০:৯৪ – সুতরাংতুমি যদি সে বস্তু সম্পর্কে কোন সন্দেহের সম্মুখীন হয়ে থাক যা তোমার প্রতি আমি নাযিল করেছি, তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো যারা তোমার পূর্ব থেকে কিতাব পাঠ করছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তোমার পরওয়ারদেগারের নিকট থেকে তোমার নিকট সত্য বিষয় এসেছে। কাজেই তুমি কস্মিনকালেও সন্দেহকারী হয়ো না।
>>> পাঠক, আসুন আমরা ১০:৯৪ আয়াতটিকে একটু মনোযোগের সাথে পর্যালোচনা করি। বলা হচ্ছে, “তুমি যদি সন্দেহ ভাজন হও তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো”। কাকে জিজ্ঞেস করতে হবে? যারা তোমার পূর্ব থেকে কিতাব পাঠ করছে! অর্থাৎ আহলে কিতাবদের। অর্থাৎ, ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের। যারা সর্বদাই মুহাম্মদের দাবীকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করে এসেছেন।
অর্থাৎ “আল্লাহ” মুহাম্মদকে পরামর্শ দিচ্ছে, “হে মুহাম্মদ তুমি যদি সন্দেহের সম্মুখীন হও তবে যারা তোমাকে নবী হিসাবে বিশ্বাসই করে না সেই অবিশ্বাসীদের জিজ্ঞেস করে তুমি যে সত্য নবী এ বিশয়ে সন্দেহ মুক্ত হও!”পাঠক, কিছু কি বুঝতে পারলেন? বুঝতে না পারলে হতাশ হওয়ার কোনোই কারণ নেই! Let me try again!
কল্পনা করুন আপনি একজন ধর্মপ্রচারক। আপনার প্রচারণাকে যারা বিশ্বাস করে না। আপনাকে যারা মিথ্যাবাদী-জালিয়াত-পাগল বলে জানে। আপনার মনেও যদি কখনো তাদেরই মত সন্দেহের উদ্রেক হয়। তবে সে অবস্থায় আপনি যে সত্যিই একজন “সত্যবাদী” তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদেরকেই জিজ্ঞেস করুন যারা আপনাকে “মিথ্যাবাদী” বলে জানে!
কী বললেন? এ তো পাগল প্রলাপ? পাঠক, আপনারা জ্ঞানী। তাই সমস্যাটা অতি সহজেই ধরতে পেরেছেন। সপ্তম শতাব্দীর বিখ্যাত তাফসীর-কার তানভীর আল-মিক-বাস (মৃত্যু ৬৮৭ খৃষ্টাব্দ) সম্ভবতঃ আপনাদের মতই ১০:৯৪-এর সমস্যাটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই তিনি হয়তো এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে উক্ত আয়াতে “মুহাম্মদের সন্দেহ”-এর কোনো আভাস দেয়া হয় নাই! তাঁর মতে, ‘উক্ত বাণীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক ‘আহলে কিতাবদের সন্দেহের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন! তাঁর মতে, উক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক আহলে কিতাব অর্থে “ইহুদী-খ্রিষ্টান” কে নয়, ‘আবদুল্লাহ ইবনে সালাম’ নামক এক নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝাতে চেয়েছেন:
“The Prophet (pbuh) did not ask nor was he ever in doubt about the Qur’an. Rather, Allah was addressing with these words the people of the Prophet.”
>>> আল্লাহ পাকের এই সহজ সরল (তুমি যদি –) বাণীটি যে কী উপায়ে ‘আহলে কিতাবের সন্দেহ’ রূপে রূপান্তরিত হলো তা মোটেও বোধগম্য নয়। অন্যদিকে তাফসীরে আল জালা-লীন (মৃত্যু, ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দ) কিংবা তাফসীরে ইবনে কাথির (১৩০১-১৩৭৩ খৃষ্টাব্দ) উক্ত আয়াতে ‘মুহাম্মদের সন্দেহের’ ব্যাপারে কোনোরূপ দ্বিমত পোষণ করেন নাই। তাফসীর ইবনে আব্বাসের মত তারা কোনো “কসরতের”আশ্রয় নেননি।
সত্য হলো, সেই শুরু থেকেই মুহাম্মদ ও তার বাণীকে সর্বদাই তাঁর পরিপার্শ্বের প্রায় সকল মানুষ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। তারা মুহাম্মদের প্রচারণায় শুধু যে নতুনত্বের কোনোই সন্ধান পাননি, তাইই নয়, তাঁরা তাঁকে জানতেন এক মিথ্যাবাদী, জালিয়াত(forged Quran), যাদুগ্রস্থ (Bewitched) ও উন্মাদ রূপে। মুহাম্মদ তাদের সেই অভিযোগের কোনো সদুত্তরই দিতে পারেননি। দেখাতে পারেননি তারই প্রচারিত অন্যান্য নবীদের উপাখ্যান সদৃশ কোনো অলৌকিকত্ব (বিস্তারিত আলোচনা করবো মুহাম্মদের মোজেজা তত্বে)। উপর্যুপরি মুহাম্মদ সর্বদায় তার প্রচারণায় কুরাইশ ও তাদের দেবদেবী এবং পূর্বপুরুষদের করতেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। দিতেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকি-শাসানি। করতেন ভীতি প্রদর্শন, শাপ-অভিশাপ! ফলাফল, মুহাম্মদের ১৩ বছরের মক্কা প্রচারণায় ফসল অনূর্ধ্ব মাত্র ১৩০ জন অনুসারী।
শুধু কি তাই? মুহাম্মদেরই জবানবন্দীর (কুরান) পর্যালোচনায় আমরা আরও জেনেছি যে বিভিন্ন কসরতের মাধ্যমে যাদেরকে তিনি অনুসারী করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাদেরও অনেকেই পুরোপুরি সন্দেহাতীত ছিলেন না। ওপরে বর্ণিত ‘মুমিনদের সন্দেহ’তার উজ্জ্বল সাক্ষ্য।
মুহাম্মদ ও তার নিবেদিতপ্রাণ অনুসারীরা মদিনায় হিজরত পরবর্তী সময়ের শুরু থেকেই কুরাইশ/অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অনৈতিক সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। সন্ত্রাসী কায়দায় অমানুষিক নৃশংসতায় বিরুদ্ধবাদীদের করেছেন খুন! উন্মত্ত শক্তি প্রয়োগে বংশ পরম্পরায় বসবাসরত শতশত বছরের জন্মভূমি/আবাসস্থল থেকে তাদেরকে করেছেন উচ্ছেদ। লুট করেছেন তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। তাদেরকে করেছেন বন্দী! ভাগাভাগি করে নিয়েছেন তাদের বউ-বাচ্চা-পরিজনদের! যৌনদাসী বানিয়েছেন তাদের স্ত্রী-কন্যাদের! ইত্যাদি, ইত্যাদি নানা উপায়ে মুহাম্মদ ও তার অনুসারীরা অবিশ্বাসীদের “বিশ্বাসী” হতে বাধ্য করেছেন।
সত্য হলো মুহাম্মদের প্রচারণার শুরু থেকে কোন কালেই মুহাম্মদ সন্দেহাতীত ছিলেন না। এখনও নেই! আজ ১৪০০ বছর পরে মুহাম্মদের প্রচারিত মতবাদের (Ideology) ব্যবহারিক প্রক্রিয়ায় তা আরও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে। ইসলাম অনুসারীরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, চিন্তা-ভাবনায়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিক্ষা-মর্যাদায় পৃথিবীর সর্বনিম্ন (দুটি ভিডিও, সাকুল্যে ১১ মিনিট: এক, দুই) । তাদের এ দুরবস্থার জন্য দায়ী কারণগুলোর অন্যতমটি হচ্ছে “ইসলামের মূল শিক্ষা”, যাকে সর্বদাই পেশীশক্তি, হুমকি ও মিথ্যার আড়ালে গোপন রাখা হয়েছে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা-সমালোচনা, পারিপার্শ্বিকতা ও লব্ধ জ্ঞানের আলোকে সাধারণ মুসলমানেরা সে সত্যকে সহজেই যাচাই করে নিতে পারবেন। প্রয়োজন শুধুই সদিচ্ছা।
সুতরাং, আমরা কুরানেরই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-বিশ্লেষণ ও যুক্তির আলোকে স্পষ্টই জানতে পারছি যে সংকলিত কুরানের বোধগম্য সর্বপ্রথম বাণী “এ সেই কিতাব যাতে কোনোই সন্দেহ নেই” দাবীটির আদৌ কোনো ভিত্তি নেই।
[কুরানের উদ্ধৃতিগুলো সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ (হেরেম শরীফের খাদেম) কর্তৃক বিতরণকৃত বাংলা তরজমা থেকে নেয়া; অনুবাদে ত্রুটি–বিচ্যুতির দায় অনুবাদকারীর। কুরানের ছয়জন বিশিষ্ট অনুবাদকারীর পাশাপাশি অনুবাদ এখানে।
(চলবে)
Leave a Reply