জিন আছে বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করে, কারণ কোরানে সে কথা বলা আছে। জিন যথেষ্ট ক্ষমতাধরও। আর তাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে বিস্মিত হবার কিছু নেই তো!
এমবিবিএস ডিগ্রি নেই তাঁর। নেননি অস্ত্রোপচারের ওপর কোনো প্রশিক্ষণও। এর পরও পেটের ব্যথা, নাকের পলিপাসসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার চিকিৎসার নামে অস্ত্রোপচার করেন তিনি।
নিজেকে তিনি পীর বলে দাবি করেন। আরও দাবি করেন, তিনি নন, জিন অস্ত্রোপচার করে এবং এতে এ পর্যন্ত অনেক রোগী সুস্থ হয়েছেন। এভাবেই গত জানুয়ারি থেকে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের চরকগাছিয়া গ্রামে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা চালাচ্ছেন এক কথিত পীর। তাঁর নাম মো. ইব্রাহিম।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ইব্রাহিমের বাড়িতে অস্ত্রোপচার করার পর এ পর্যন্ত দুই নারী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
লোকমুখে জিন দিয়ে সব রোগের চিকিৎসা করার কথা শুনে বরগুনা সদরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য রোগী প্রতিদিন ছুটে আসছেন ইব্রাহিমের চরকগাছিয়া গ্রামের বাড়িতে। এ সুযোগে রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এ ছাড়া মানতের নামে নিচ্ছেন ছাগল, হাঁস-মুরগি, চাল-ডালসহ নানা পণ্যসামগ্রী। প্রতিদিন গড়ে এখানে ১০০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন।
বরগুনার সিভিল সার্জন এ এইচ এম জহিরুল ইসলাম জানান, এটা এক ধরনের প্রতারণা। চিকিৎসাবিধি অনুযায়ী একজন সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসক (সার্জন) ছাড়া কোনোক্রমেই কেউ অস্ত্রোপচার করতে পারেন না। এ ধরনের অস্ত্রোপচারের ফলে রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে; এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে ওই কথিত পীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৩ জুলাই সকালে ইব্রাহিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০-৬০ জন রোগী অপেক্ষা করছেন। ঘরের নির্দিষ্ট একটি কক্ষে বসে একেকজন করে রোগীকে ভেতরে নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন ইব্রাহিম। এখানে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। ঘরের পেছনে নর্দমায় অসংখ্য রক্তমাখা গজ-ব্যান্ডেজ, তুলা ও সিগারেটের খালি প্যাকেট ফেলে রাখা হয়েছে।
ঘরের বারান্দার এক পাশে একটি কক্ষে ইব্রাহিম নারী রোগীদের চিকিৎসা দেন। সেখানে একটি চৌকির ওপর হোগলা বিছানো এবং এর ওপরে কিছু ব্যান্ডেজ, কাপড়, আগরবাতি ও সরিষার তেলের বোতল, সুঁই-সুতা। পাশে একটি সাদাকালো টিভি ও ভিসিডি প্লেয়ার রাখা।
বরগুনার টাউন হল সড়কের সুমী বেগম বলেন, ‘আমাকে দেখে ইব্রাহিম হুজুর বলে, তোমার লিভার খারাপ হয়ে গেছে, অপারেশন লাগবে। অপারেশনের অগে সে মন্ত্র পড়ে এক গ্লাস পানি খেতে দেয়। তারপর একটি সাদা কাপড় দিয়ে আমার সারা শরীর ঢেকে দেয়। এরপর একটি কাঁচি দিয়ে আমার তলপেট কাটে। এতে আমি সামান্য ব্যথা পাই। পরে সোনামুখি সুঁই ও সুতা দিয়ে তলপেট সেলাই করে দেয়। কিছুদিন পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।’
বরগুনা শহরের টাউন হল সড়কের বাসিন্দা সেলিনা বেগম অভিযোগ করেন, ‘পেটে জটিল ব্যথার চিকিৎসার জন্য ২৪ জুন ইব্রাহিম আমার পেটে অস্ত্রোপচার করেন। এতে আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। চিকিৎসার খরচ বাবদ হুজুর আমার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন।’
নাকের পলিপাসের চিকিৎসা করিয়েছেন পূর্ব হাজারবিঘা গ্রামের রফিকুল ইসলাম। রফিকুল বলেন, ‘হুজুর খেজুরের কাঁটা দিয়ে নাকের ভেতরে ছিদ্র করে দিয়েছেন। এতে সুবিধা হবে কি না, তা জানি না।’
ইব্রাহিম দাবি করেন, তিনি বাগেরহাটের খাজা খানজাহান আলীর মাজারের একজন খাদেম। পীর সাহেবের দয়ায় আল্লাহ সব রোগ ভালো করেন। প্রথমে শুধু ১১ টাকা চেরাগি (ফি) নেন এবং রোগমুক্তির পর খুশি হয়ে অনেকে টাকা-পয়সা দিয়ে যান। জিন দিয়ে রোগীদের অস্ত্রোপচার করানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি রোগীদের কাছ থেকে অস্ত্রোপচারের জন্য টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
চরকগাছিয়া গ্রামের লোকজন জানান, ইব্রাহিম এই গ্রামের আ. আজিজ মীরের ছেলে। বছর দশেক আগে তিনি আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। দুই বছর পর তিনি বাড়ি থেকে অজানার উদ্দেশে চলে যান। পাঁচ-ছয় মাস আগে তিনি বাড়িতে ফিরে এসে টিনের ঘর তুলে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন।
চরকগাছিয়া সিনিয়র দাখিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসার নামে এটা এক ধরনের প্রতারণা। ইসলাম এ ধরনের প্রতারণা সমর্থন করে না।’
Leave a Reply