লিখেছেন : কবিতা রায়
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তৈরি করার পিছনে নয় একেবারে সামনেই ইংরেজদের হাত ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সহিংস বিপ্লবের বদলে নিয়মতান্ত্রিক অহিংস পথে ভারতবাসীকে চালনা করা। এটা কংগ্রেসেরই লেখা ইতিহাসে স্বীকার করা হয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতকে কোম্পানীর হাত থেকে মহারাণীর সরকারের হাতে হস্তান্তরের পর কিছুদিন ভারতীয়রা এই ভেবে শান্ত ছিল যে এবারে তাদের উপর অবিচার বন্ধ হবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় যখন দেশে আবার একটা বিদ্রোহের সম্ভাবনা জেগে উঠতে লেগেছে তখনই সেটা থামাতে কংগ্রেসের জন্ম।
এই কংগ্রেসী পদ্ধতিতে অনেকদিন চেষ্টা চালানোর পর একদিকে যেমন দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা বুড়ো হতে থাকলেন তেমনই নতুন সদস্যরা এই পদ্ধতির উপর আস্থা হারাতে থাকল। ফলে সহিংস বিপ্লবীরা আবার বাড়তে শুরু করে। বাড়তে বাড়তে একদিন রাসবিহারীর চেলা বসন্ত বিশ্বাস দিল্লিতে স্বয়ং বড়লাটের উপর বোমা ছুঁড়ে বসলেন। সেটা ছিল ১৯১২ সালের ডিসেম্বর। এতে রাসবিহারী বসু এক আদর্শ নেতার জায়গা নিতে শুরু করেন। বহু চেষ্টাতেও রাসবিহারীকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে অবশেষে ১৯১৫ সালে ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের অহিংসা শেখানোর জন্য গান্ধীকে সাউথ আফ্রিকা থেকে এনে বসিয়ে দেয়। অহিংস আন্দোলনে কাজ হয় এটা প্রমাণ করতে কয়েকটা ছোটোখাটো ইস্যুতে গান্ধীকে জিতিয়েও দেওয়া হয়।
১৯২০ সালের দিকে গান্ধী যে অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলন করেছিলেন সেটা মূলত পূর্ণ স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে ছিল না। যদিও কংগ্রেসের নবীন নেতারা স্বাধীনতার দাবীই করেছিলেন কিন্তু গান্ধীর ইচ্ছা ছিল ডমিনিয়ন। আসলে কংগ্রেসের আশা ছিল যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজরা ভারতকে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দেবে। যদি তা না দেয় তবে পূর্ণ স্বাধীনতার আন্দোলন করার প্রস্তাব ছিল। সেই অনুযায়ী অন্যান্য নেতাদের চাপে পড়ে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুললেও তাই প্রথম সুযোগেই গান্ধী আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলেন।
গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় সর্বভারতীয় আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের পরেই ১৯৩২ সালে ইংরেজ সরকার তাদের নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করল। সেটি হল ভারতের পার্লামেন্টে জাতিভিত্তিক কোটা দেওয়া। মুসলিম, বৌদ্ধ, শিখ, ক্রিশ্চান, হিন্দু ফরোয়ার্ড ক্লাস এবং হিন্দু ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের জন্য আলাদা সিটের প্রস্তাব ছিল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধী এই প্রস্তাবে অন্যান্য জাতির বেলায় নিরপেক্ষতা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু হিন্দু ফরোয়ার্ড-ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের বিভাজনের বিরোধিতা করেন। নেতাজী এবং প্যাটেল সবরকম জাতিভিত্তিক কোটার বিরোধিতা জানিয়ে বোস-প্যাটেল ম্যানিফেস্টো বের করেন। নেতাজীর মতে এই কোটা ব্যবস্থা ভারতকে বিভাজিত করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
আম্বেদকর যখন দেখলেন কংগ্রেসীরা সিড্যুল কাস্টদের কোটা দেবার পক্ষে নেই তখন তিনি কংগ্রেসকে বামুন-বেনিয়ার দল বলে গালাগালি শুরু করলেন এবং শেষ অবধি আন্দোলন করে সেই কোটা আদায় করেই ছাড়লেন। এই দাবী আদায়ে তিনি মুসলিম লীগের পুরো সাহায্য পেয়েছিলেন। এর বিনিময়ে পাকিস্তান প্রস্তাবের সমর্থন করা, দলিতদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে রাখা ইত্যাদি কাজ তিনি ভালভাবেই করে গেছেন। মুসলিমদের ইতিহাস-ভুগোল তিনি ভালভাবেই জানতেন, কিন্তু পুরো দেশের চিন্তা তাঁর কোনোকালেই ছিলনা। তিনি কেবল সিড্যুলকাস্টদেরই ভাবনা ভাবতেন। সেজন্য মুসলিম লীগের সাথে হাত মেলাতে তাঁর আপত্তি হয়নি। মুসলিমদের পাকিস্তান দাবীর মতো সিড্যুলকাস্টদের জন্য আলাদা দেশের দাবী করার হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন।
১৯৪২ সালে আম্বেদকর সিড্যুলকাস্ট ফেডারেশন দল তৈরি করেন। সেই দলেরই বাংলা শাখার নেতা ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ৪৬ সালের দাঙ্গার অর্থাৎ ওনাদের মতে বড়লোক হিন্দুদের বিরুদ্ধে গরীব মুসলমানের শ্রেণীসংগ্রাম শুরু হলে যোগেনবাবু দলিতদেরকে বড়লোক হিন্দুদের পক্ষ নিয়ে মুসলিম বিরোধিতা না করার নির্দেশ দেন। এর পুরষ্কার হিসাবে যোগেনবাবু পাকিস্তানের সরকারে আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ অবধি আড়াই কোটি হিন্দুকে পাকিস্তান থেকে তাড়ানো হয় তারপর ১৯৫০ সালে যোগেনবাবুও পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন এবং পাকিস্তানে দলিতদের উপর অত্যাচারের এক লম্বা বয়ান দেন। সেই বয়ানে তিনি পাকিস্তানের সেবায় নিজের এবং দলের নেতা আম্বেদকরের অবদান সম্পর্কে লিখেছেনঃ
কলকাতা হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৪৬ এর অক্টোবরে শুরু হয় নোয়াখালীর দাঙ্গা। সেখানে শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে(নমঃশূদ্র সহ) হত্যা করা হয় এবং জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। হিন্দু মহিলারা অপহরণ এবং ধর্ষণের শিকার হন। আমার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরও জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি ত্রিপুরা ও ফেনী যাই এবং কিছু দাঙ্গাপীড়িত এলাকা পরিদর্শন করি। হিন্দুদের দুর্দশা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করে, কিন্তু আমি মুসলিম লীগের সাথে সহযোগিতা চালিয়ে যাই। কলকাতার বিশাল হত্যাযজ্ঞের পরপর সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে এক ভোটাভুটি আয়োজিত হয়। শুধুমাত্র আমার চেষ্টা দ্বারাই কংগ্রেসের পক্ষের চারজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্য এবং চারজন অস্পৃশ্য সদস্যের সমর্থন যোগাড় করা সম্ভব হয় যা ব্যতীত মন্ত্রীসভার পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী।
আম্বেদকরের পার্টির বাংলা শাখার নেতা যোগেনবাবু যখন পাকিস্তান ছেড়ে পালালেন সেই ১৯৫০ সালে আম্বেদকর বহাল তবিয়ত বেঁচে ছিলেন। এরপর ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালে তিনি দুবার ভোটেও লড়েছিলেন। পাকিস্তানে ওনার জাতভাই দলিতদের অবস্থা নিয়ে এই চার বছরে আম্বেদকর কী বলেছেন সেটা কিন্তু ওনার ভক্তরা একেবারেই জানাতে চায় না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ অবধি, অর্থাৎ যোগেনবাবু ভারতে পালিয়ে এসে বয়ান দেবার আগে অবধি উনি কিছু জানতেন না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা বহু লোকই কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে নেতা হয়েছেন। বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। কিন্তু আম্বেদকরের এই প্রিয় নেতা যোগেনবাবু কেন মুছে গেলেন? সেটা কি পাকিস্তানের সমালোচনা করার কারণে? নাকি আম্বেদকরের নামটা টেনে এনেছিলেন বলে? ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালে আম্বেদকর নিজে যখন ইলেকশন লড়ছেন তখন যোগেন মন্ডল কেন ফিল্ডে ছিলেন না?
তার চেয়েও বড় একটা প্রশ্ন থেকে যায়। নেতাজী দুবার কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন, গান্ধীর সমর্থিত প্রতিযোগীকে হারিয়েছিলেন, কলকাতার মেয়র পদেও কিছুদিন ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের থেকে নেতাজীকে তাড়াতে গান্ধীর এক দিনও লাগেনি। সেই তুলনায় আম্বেদকরের গুরুত্ব কী ছিল? যোগেন মন্ডলের দাম কী ছিল? ওনারা জীবনেও একবারও কোনো ইলেকশন জেতেননি। এই গুরুত্বহীন আম্বেদকরকে দিয়ে কংগ্রেস কেন ভারতের সংবিধান লেখাবে? যে আম্বেদকর প্রকাশ্যে কংগ্রেসকে বামুন-বেনিয়ার দল বলেছেন। যে আম্বেদকর গান্ধীকে আন্দোলনের নাটকবাজ বলেছেন। যে আম্বেদকর প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে ইংরেজ রাজত্ব ভালো। সেই আম্বেদকরকে এতবড় কাজ কেন দেওয়া হবে?
দেওয়া হবে কারণ ইংরেজের তাই ইচ্ছা। যে ইংরেজের ইচ্ছা ছিল ভারতের পার্লামেন্টে একটা জাতের ভাগাভাগি হোক। তাই নেতাজীর মতো বিশ্ববিখ্যাত নেতাকে দলছাড়া এবং তারপর দেশছাড়া করতে পারা কংগ্রেস আম্বেদকরকে সংবিধান লিখতে দেয়। জিন্নাকে পাকিস্তান দেয়, পাকিস্তানকে কাশ্মীর দেয়। সবই হয়েছিল ইংরেজ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের ইচ্ছায়। যে মাউন্টব্যাটেন স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসাবে নেহেরুকে চালাতেন। তিনি চাইতেন, তাই লর্ড ওয়াভেলের আমদানি করা সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি ভারতের সংবিধানে ঢুকেছে।
Leave a Reply