কুরআন হাদীসের আলোকে
জান্নাতের
চিত্র
সংকলনে
আবু মুসয়াব
সিরাতুল মুস্তাকিম পাবলিকেশন
৩৮, বাংলাবাজার, ঢাকা
বিনিময় : ১০.০০ টাকা।
জান্নাত
“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে তারাই সৃষ্টি জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তাদের পুরষ্কার রয়েছে তাদের রবের কাছে, তা হলো জান্নাত—যার নিচ দিয়ে ঝরনা প্রবাহিত হয়, সেখানে তারা অবস্থান করবে চিরকাল।“—(সুরা-আল-বাইয়িনাহ্ : ৭-৮)
১. জান্নাত
জান্নাত এক বচন, বহু বচনে অর্থ ঘনো সন্নিবেশিত বাগান, রাগবাগিচা। আরবীতে বাগানকে রওজাতুন এবং হাদীকাতুন ও বলা হয়। কিন্তু জান্নাত শব্দটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিজস্ব একটি পরিভাষা। পারিভাষিক অর্থে জান্নাত বলতে এমন স্থানকে বুঝায়, যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। যা দিগন্ত বিস্তৃত নানা রকম ফুলে ফলে সুশোভিত। সুরম্য অট্টালিকা সম্বলিত মনোমান্ধকর বাগান; যার পাশ দিয়ে প্রবাহমান বিভিন্ন ধরনের নদী নালা ও ঝর্ণাধারা। যেখানে চির বসন্ত বিরাজমান।
আমরা জান্নাতকে বেহেশতও বলে থাকি। বেহেশত ফার্সী শব্দ। আমরা আমাদের এ পুস্তকে আরবী শব্দটিই ব্যবহার করবো ।
২. জান্নাত মোট আট প্রকার
আট প্রকার জান্নাতের কথাই আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকার গুলো হচ্ছেঃ ১)জান্নাতুস ফিরদাউস। ২) জান্নাতু নায়ীম। ৩) জান্নাতুল মাওয়া।। ৪) জন্নাতুর আদন। ৫) জান্নাতুল দারুস সালাম। ৬) জান্নাতুদ দারুল খুলদ। ৭) জান্নাতুল দারুল মাকাম।। ৮) জান্নাতুল ইল্লিয়্যুন।
৩. জান্নাতের প্রশস্ততা
মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা একে অপরের সাথে সৎকাজে প্রতিযোগিতামূলক অগ্রসর হও। তোমার প্রভুর ক্ষমা এবং সে জান্নাতের দিকে, যার বিশালতা ও বিস্তৃতি আকাশ ও পৃথিবীর ন্যায়।” (সূরা হাদীদ : ২১)
হাদীসে আছে আল্লাহ যাকে সবচেয়ে ছোট জিন্নাত দেবেন তাকেও পৃথিবীর মতো দশ পৃথিবীর সমান জান্নাত দেবেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “সেখানে (জান্নাতে) যে দিকে তোমরা তাকাবে শুধু নিয়ামত আর নিয়ামত এবং একটি বিরাট সাম্রাজ্যের সাজ সরঞ্জাম দেখবে পাবে।” (সূরা দাহর ঃ ২০)
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “জান্নাতে একশতটি স্তর আছে। সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি একত্রিত হয়ে তার কোন একটিতে আশ্রয় নেয়, তবে তা তাদের জন্য যথেষ্ট হবে।”-(তিরমিযি)
অন্য হাদীসে আছে- “প্রতি স্তরের মধ্যে ব্যবধান একশত বৎসরে অতিক্রান্ত দূরত্বের সমান।।” (তিরমিযি)
৪. সম্পূর্ণ জান্নাত হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
জান্নাতে সর্বদা বসন্তকাল বিরাজ করবে। ফুল-ফলের সমাহার এবং – সৌন্দৰ্য শ্যামলতা কখনো ম্লান হবে না। এমন কি গোটা জান্নাত শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বা এয়ার কণ্ডিশন হবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ “তাদেরকে সেখানে (জান্নাতে) না সূৰ্যতাপ জ্বালাতন করবে না। শৈড্য প্রবাহ।”-(সূরা দাহর ঃ ১৩)
৫. জান্নাতের অট্টালিকাসমূহ
গম্বুজ থাকবে। যা মুক্তা যাবরজদ। ইয়াকুত দ্বারা নির্মিত হবে। এবং তা এতা বিশাল হবে যে, তার দূরত্ব হবে সানআ’ হতে জারিয়া পর্যন্ত।- (তিরমিযি)
হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “নিঃসন্দেহে জান্নাতে মুমিনের জন্য এমন একটি তাবু থাকবে যা মোতির তৈরী এবং ভেতর দিকে ফাঁপা।-(বুখারী ও মুসলিম)
৬. জান্নাতে কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না
পৃথিবীতে মানুষ যতো বিত্তশালী হোকক এবং যতো সুখ-শান্তি ভোগ করুক না কেনো তবু তার কোন না কোন দুঃখ বা অশান্তি থাকেই, কোন মানুষই সম্পূর্ণ সুখী হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জান্নাতে কোন দুঃখই থাকবে না, এমন কি পৃথিবীতে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের অধিকারী হয়েও আরো বেশী পাওয়ার জন্য এবং ভোগ করার জন্য দুঃখের শেষ থাকে না। পক্ষান্তরে জান্নাতীগণ–যাকে সবচেয়ে ছোট জান্নাত দেয়া হবে তারও কোন অনুতাপ বা দুঃখ থাকবে না। আল্লাহ-নিজেই এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
“তারা সেখানে কখনও কোন দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হবে না এবং কোন দিন সেখান থেকে তাদেরকে বের করে দেয়া হবে না।”-(সূরা হিজর ঃ ৪৮)
“(জান্নাতীগণ বলবে) তিনি আমাদেরকে নিজের অনুগ্রহে চিরন্তনী আবাসস্থল দান করেছেন এবং আমাদের কোন দুঃখ এবং ক্লান্তি নেই।” (সূরা ফাতির ঃ ৩৫)
নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ “যারা জান্নাতে যাবে তারা সর্বদা স্বচ্ছল অবস্থায় থাকবে, দারিদ্র ও অনাহারে কষ্ট পাবে না। তাদের পোশাক পুরাতন হবে না এবং তাদের যৌবন ও কোনদিন শেষ হবে না। “-(মুসলিম)
৭. জান্নাতে অশ্লীল কথা শুনা যাবে না
পৃথিবীতে যতো ঝগড়া ফাসাদ সমস্তই স্বার্থপরতা, অহংকার ও হিংসার কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। জান্নাতে স্বার্থপরতা, অহংকার, হিংসা ইত্যাদি থাকবে না, তাই সেখানে গীবত, পরনিন্দা, পরিচর্চা, ঝগড়া-বিবাদ, অশ্লীল কথাবার্তা ইত্যাদি কিছুই থাকবে না। সেখানে শুধু সম্পপ্রীতি ও সৌন্দর্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করবে।
৮. যা পেতে ইচ্ছে করবে। তাই পাবে
পৃথিবীতে কোন জিনিস পেতে হলে বা ভোগ করতে চাইলে সে জিনিসের জন্য চেষ্টা শ্রম ও কোন কোন ক্ষেত্রে টাকা বা সম্পদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু জান্নাতে ইচ্ছে হওয়া মাত্রই সে জিনিস তার সামনে উপস্থিত থাবো। এ ব্যাপারে। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেনঃ :
“সেখানে তোমরা যা কিছু চাও পাবে এবং ইচ্ছে করবে সাথে সাথে তাই হবে। এটা হচ্ছে ক্ষমাশীল ও দয়াবান আল্লাহর তরফ হতে মেহমানদারী।”-(সূরা হা-মীম আস সিজদাঃ ৩০-৩১)
একবার এক সাহাবী আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! জান্নাতে কি ঘোড়াও পাওয়া যাবে? তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ “আল্লাহ্ তা’আল যদি তোমাকে জান্নাতেই প্রবেশ করান তবে সেখানে লাল ইয়াকুত পাথরের ঘোড়াও যদি তুমি আরোহন করতে চাও যা তোমার ইচ্ছেনুযায়ী জান্নাতে ভ্ৰমন করবে তবে তাও তোমাকে দেয়া হবে।” (এটি একটি দীর্ঘ হাদীস। এ হাদীসে আরো বলা হয়েছে)
“আল্লাহ যদি তোমাকে জান্নাতবাসী করেন, তবে তুমি যা চাবে তাই পাবে। যে সমস্ত বস্তু দেখে তোমার মন খুশী হয়ে যাবে এবং চোখ জুড়িয়ে যাবে তার সমস্ত তোমাকে দেয়া হবে।-(মিশকাত)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
“এবং আমি জান্নাতীদেরকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ফল ও গোশত প্রদান করতে থাকবো।”-(সূরা তুর ঃ ২২)
এ দান স্থান ও কালের সাথে সীমাবদ্ধ হবে না, নিয়মিতভাবে চিরদিন প্রদান করা হবে । যেমন আব্দুল্লাহ বলেনঃ
“এবং সেখানে তাদেরকে (নিয়মিতভাবে) সকাল সন্ধ্যা খাদ্য পরিবেশন করা হবে।”-(সূরা মারইয়াম ঃ ৬২)
৯. অসীম সুখ-সম্ভার কোনদিন শেষ হবে না
পৃথিবীতে যদিও কোন ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুখ সম্ভোগ লাভ করতে পারে না; – তবুও যতোটুকু পায় তার মধ্যে প্রতিটি মুহুর্ত ভীত সন্ত্রস্ত থাকে চার-ডাকাত, প্রতারক এবং মৃত্যুর ভয়ে ; কিন্তু জান্নাতের নিয়ামত এবং সুখ ভোগ কোন দিনই কমতি বা শেষ হবে না । আল্লাহ বলেনঃ
“তাদের জন্য কাঁটাবৃক্ষসমূহ, থরে থরে সাজানো কলা, বিস্তৃর্ণ অঞ্চলব্যাপী ছায়া, সর্বদা প্রবাহমান পানি, আর খুব প্রচুর পরিমাণে ফল থাকবে যা কোনদিন শেষ হবে না এবং ভোগ করতে কোন বাধা থাকবে না।”-(সূরা ওয়াকিয়া ঃ ২৮-৩৩) … ”
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহ যার দ্বারগুলো তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকবে সেখানে তারা ঠেস দিয়ে বসবে এবং প্রচুর ফল ও পানীয় চেয়ে পাঠাবে, আর তাদের নিকট লজ্জাবনত সমবয়স্কা স্ত্রী থাকবে। এ জিনিসগুলো এমন যা হিসেবের দিন দান করার জন্য তোমাদের নিকট ওয়াদা করা হয়েছে। এটা আমাদের দেয়া রিফিক, কোন দিন শেষ হয়ে যাবে না।”-(সূরা সাদ ঃ ৫০-৫৪)
১০. জান্নাতীদেরকে পবিত্ৰা স্ত্রী ও হুরদের সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিয়ে দিবেন
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ “তারা সামনা সামনিভাবে সাজানো সারি সারি আসনের উপর ঠেস দিয়ে বসে থাকবে এবং তাদের সাথে সুনয়না হুরদেরকে বিবাহ দেবো।” (সুরা তুর : ২০) .
হুর বহু বচনের শব্দ। একবচনে অর্থ অত্যন্ত সুশ্রী, অনিন্দনীয় সুন্দরী; আরেক অর্থ ভাসা ভাসা ডাগর চক্ষুওয়ালা রমনী। যাদেরকে বাংলা সাহিত্যের ভাষায় হরিণ নয়না বলা হয়। হুর সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুফাচ্ছিরগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছেন, এক দলের মতেঃ
সম্ভবত এরা হবে সেসব মেয়ে যারা বালেগা হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলো এবং যাদের পিতা-মাতা জান্নাতে যাওয়ার, যোগ্য হয়নি। সে সব মেয়েদেরকে ষোড়শী যুবতী করে হুরে রুপান্তর করা হবে। আর তারা চিরদিন নব্য যুবতীই থেকে যাবে।
অন্যদের মতে হুরগণ প্রকৃতপক্ষে স্ত্রী জাতি কিন্তু তাদের সৃষ্টি মানব সৃষ্টির চেয়ে আলাদা এবং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আপন মহিমায় তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।
অন্যত্র বলা হয়েছে “(এসব নিয়ামতের মধ্যে থাকবে) তাদের জন্য সচ্চরিত্রবান ও সুদর্শন স্ত্রীগণ।”-(সূরা আর-রাহমান ঃ ৭০)
সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছেঃ “যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য এমন উদ্যানসমূহ রয়েছে যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান। আর সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। সেখানে তাদের জন্য আরও আছে পবিত্ৰা স্ত্রীগণ ও আল্লাহর সস্তুষ্টি।”
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তাদের স্ত্রীগণকে আমরা বিশেষভাবে সম্পূর্ণ নতুন করে সৃষ্টি করবো । এবং তাদেরকে কুমারী বানিয়ে দেবো। তারা হবে নিজেদের স্বামীর প্রতি আসক্ত এবং বয়সে সমকক্ষ।”-(সূরা ওয়াকিয়া ঃ ৩৫-৩৮)
এখানে পৃথিবীর সে সব মহিলাদের কথা বলা হয়েছে, যা ‘আমলে সালেহ’ এর বিনিময়ে জান্নাতে যাবে। তারা পৃথিবীতে বিকলাঙ্গ, কালা, কুৎসিত, যুবতী, বিধবা, অথবা বুড়ি যাই হোক না কেন, আল্লাহ জান্নাতে তাদেরকে সুশ্ৰী, সুনয়না, কুমারী হিসাবে পুনরায় সৃষ্টি করবেন এবং তারা আজীবন কুমারী থাকবে। কখনো তারা বার্ধক্যে উপনীত হবে না। হযরত উন্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- “আমি নবী করীম (সাঃ)- কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! দুনিয়ার মহিলারা উত্তম না হুরগণ?” হুজুর (সাঃ) বললেন, “দুনিয়ার মহিলারা হুরদের তুলনায় শ্ৰেষ্ঠ। আমি – বললাম, “তার কারণ কি?” তিনি বললেনঃ “তা এ কারণে যে মহিলারা নামায পড়ছে, রোযা রেখেছে ও অন্যান্য ইবাদাত , বন্দেগী করছে।”- (তাবারানী)
ঐ সকল পূৰ্ণবতী মহিলাদের স্বামীরাও যদি জান্নাতী হয় তবে রাব্বুল আলামীন তাদের উভয়ের মধ্যে মিলন ঘটিয়ে দেবেন। আর ঐ সব মহিলাদের মধ্যে যাদের স্বামী জাহান্নামী হবে- তাদেরকে জান্নাতের ঐসব পুরুষের সাথে আল্লাহ নিজের অভিভাবকত্বে বিয়ে দিয়ে দেবেন যাদের স্ত্রীগণ চিরস্থায়ী জাহান্নামী ।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, পৃথিবীতে যদি কোন মহিলার একাধিক স্বামী থাকে এবং সব স্বামীই যদি জান্নাতী হয় তবে ঐ মহিলাকে আল্লাহ কোন স্বামীর স্ত্রীকে দেবেন? এর উত্তর অবশ্য উম্মে সালমা (রাঃ) বর্ণিত আরেক , হাদীস থেকেই পাওয়া যায়। –
“নবী পত্নী উম্মে সালমা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে সব মহিলার একাধিক স্বামী আছে এবং ঐ স্বামীগণ যদি সকলেই জান্নাতী হোন তবে স্ত্রীকে তাদের মধ্যে কে লাভ করবে? নবী করীম (সাঃ) বললেনঃ “সে মহিলাকে সুযোগ ও স্বাধীনতা দেয়া হবে। তখন তার স্বামীদের মধ্যে সে কোন একজনকে বাছাই করে নেবে। সে বাছাই করবে। ঐ স্বামীকে যে সর্বাধিক উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলো।”
পুণরায় আরেকটি প্রশ্ন হতে পারে, একজন জান্নাতী পুরুষ অনেক হুর পাবে পক্ষান্তরে একজন জান্নাতী মহিলা শুধুমাত্র একজন স্বামী পাবে। তাও সম্পূর্ণভাবে নিজের জন্য সংরক্ষিত থাকবে না, হুরীগণ তার শরীক থাকবে। এটা কি ইনসাফ হতে পারে?
এর দুটো উত্তর হতে পারে এবং দুটোই এখানে প্রযোজ্য।
প্রথমতঃ জান্নাতী একজন পুরুষ হুর প্রাপ্তির কথা বাদ দিলে অন্যান্য যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে এবং যেসব খাদ্য ও পানীয় খাবে, তা একজন জান্নাতী মহিলাও ভোগ করতে পারবে এবং সেদিন ঐ সব মহিলার মধ্য হতে ঈৰ্ষা এবং একাধিক পুরুষের স্ত্রী হওয়ার হীন মানসিকতা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দূর করে দেবেন। তাই তারা পরস্পর সতীন সুলভ আচরণ বা ঈর্ষা পোষণ করবে না।
দুনিয়াতে কোন মহিলাই পছন্দ করে না যে তার দুই স্বামী হোক। অর্থাৎ এটা আল্লাহ তায়ালার মহিলাদের জন্য দেয়া একটি ফিতরাত বা সহজাত প্রবৃত্তি যে, তার একজনই স্বামী হবে। অপর পক্ষে একটা পুরুষের জন্য ফিতরাত হল সে সব সময় একের অধিক স্ত্রী পাওয়ার আশাবাদী হয় । কোন পুরুষ যদি মুখে বলে না। আমি চাই না। তবে এটা মিথ্যা কথা। কারণ যে আল্লাহ নারী ও পুরুষ বানিয়েছেন সেই আল্লাহতায়ালাই জানেন পুরুষদের মনের খবর এবং তাদের ফিতরাত। তাইতে তিনি দুনিয়াতে পুরুষদেরকে সামৰ্থ্য থাকলে অসৎ কাজ থেকে দূরে থেকে চারটি পর্যন্ত বিবাহের অনুমতি দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত ঃ পৃথিবীতে যেমন মহিলাগণ সংসারের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করার জন্য সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকে এবং লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাদের সমস্ত তৎপরতা আবর্তিত হয়। পক্ষান্তরে পুরুষদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না ; তাদের মধ্যে অবশ্য ভিন্নধর্ম প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়–যেমন একাধিক স্ত্রী গ্রহণ বা স্ত্রীদের প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতা। হয়তো জান্নাতেও সেদিন এ রকম মন মানসিকতার কথা স্মরণ রেখেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পুরুষদের অনেক হুর দেবেন এবং যেহেতু স্ত্রীগণ কর্তৃত্ব করা বেশী পছন্দ করে তাই জান্নাতে সমস্ত হুর এবং খাদেমদের কর্তৃত্ব দেয়া হবে এ সব পূৰ্ণবতী স্ত্রীগণকে । (এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন)
ঐ সমস্ত হুর এবং স্ত্রীগণ শুধু কুমারীই হবে না। এমন অবস্থায় থাকবে যে, জান্নাতীদের স্পর্শের পূর্বে কোন পুরুষ অথবা জীন তাদেরকে স্পর্শ করেনি বা দেখেওনি। কেননা বিচারের পূর্বে কোন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই তাদেরকে দেখা বা স্পর্শ করাও সম্ভব নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেনঃ
“তাদেরকে (জান্নাতীদের) পূর্বে কোন মানুষ অথবা জ্বীন স্পর্শ করেনি।” -(সূরা আর রাহমান ঃ ৫৬)
হুরদের রূপ সৌন্দর্যের উপমা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেনঃ “তারা এমনই সুন্দরী রূপসী যেনো হীরা ও মুক্ত।” (সূরা আর-রাহমান ঃ ৫৮)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তারা এমন সুশ্ৰী ও সুন্দরী হবে যেনো (ঝিনুকের মধ্যে) লুকিয়ে থাকা মুক্তা।”-(সূরা ওয়াকিয়া ঃ ২৩)
আরও বলা হয়েছেঃ “তাদের নিকট (ভিন্ন পুরুষ হতে) দৃষ্টি সংরক্ষণকারী সুন্দর চক্ষু বিশিষ্ট নারীগণ থাকবে । এমন স্বচ্ছ, যেনো ডিমের খোসার নিচে লুকানো ঝিল্লি।”
ডিমের খোসার নিচে লুকানো ঝিল্লি–এ প্রসঙ্গে নবী পত্নী হযরত উম্মে সালমা বলেনঃ আমি এ আয়াতের ব্যাখ্যা নবী করীম (সাঃ)এর নিকট জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি বলেছেনঃ “তাদের (হুরদের) মসৃণতা ও স্বচ্ছতা হবে সেই ঝিল্লির মতো যা ডিমের খোসা ও তার কুসুমের মাঝে থাকে।”-ইবনে জরীরের হাওয়ালায় তাফহীম ১৩শ খন্ড পৃঃ ৫২
নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতীগণের স্ত্রীদের মধ্যে থেকে কোন একজন স্ত্রী যদি পৃথিবীর দিকে উঁকি মেরে দেখতো। তবে আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী সব কিছু আলোকিত হয়ে যেতো। এবং গোটা পৃথিবী সুগন্ধে ভরে যেতো। তার মাথার উড়ানটিও পৃথিবী এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছুর চেয়ে দামী।”-(বুখারী)
অন্য বর্ণনায় ঃ “জান্নাতের স্ত্রীগণের পায়ের গোছার স্বেতবর্ণ সত্তর পরতে কাপড়ের ৈ ভেতর থেকেও দৃষ্টি গোেছর হবে। এমন কি পায়ের গোছার মজ্জা পর্যন্তও দেখা যাবে।”- (তিরমিযি)
১১. হুরদের প্রাণ মাতানো সংগীত
হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতের মধ্যে ঘনো কালো হরিণ নয়না পরমাসুন্দরী হরদের জন্য একটি মিলনায়তন থাকবে। তারা সেখানে জমায়েত হয়ে অপূর্ব সূরে সংগীত পরিবেশন করবে। (আল্লাহর নূরের মাধুরী মাখা) এমন সুমধুর সূরের মূর্ছনা কোনদিন আর কেউ শোনেনি। তারা সমস্বরে গাইতে থাকবেঃ
ক্ষয় নেই ওগো বন্ধু ক্ষয় নেই মধু জীবনের,
ক্ষয় নেই কিন্তু এ রুপের,
এ বদন, এ যৌবনের ।
মোরা চির আনন্দময়ী, ।
চির সুখী দায়িনী,
মোরা চির তুষ্ট-প্ৰাণ,
চির মনোহারিনী।
প্রীতি সুখ তার তরে যে আমার,
মন ও মায়া তার তরে যে আমি যার।
সুখী তারা মোরা হয়েছি যাদের।
-(তিরমিযি)
১২. জান্নাতীদের খেদমতের জন্য অসংখ্য গিলমান থাকবে
জান্নাতীদের জন্য হুরের পাশাপাশি গিলমান থাকবে। গিলমান বহুবচন, একবচনে অৰ্থ দাস, সেবক ইত্যাদি।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আর তাদের সেবা যত্নে সে সব বালক দৌড়াদৌড়ির কাজে নিযুক্ত থাকবে যারা কেবলমাত্র তাদের জন্যই নির্দিষ্ট। এরা এমন সুন্দর সুশ্ৰী হবে যেমন (ঝিনুক) লুকিয়ে থাকা মুক্তা।”-(সূরা তুর ঃ ২৪)
গিলমান বা সেবকগণ হবে চিরন্তন বালক। এদের বয়স কোনদিনই বাড়বে না। এই সেইসব বালক যারা বালেগ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে এবং তাদের মা-বাবা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। অথবা তারা হবে এক নতুন সৃষ্টি যাদেরকে আল্লাহ। আপন মহিমায় জান্নাতীদের পরিচর্য ও সেবার জন্য সৃষ্টি করবেন (আল্লাহই সৰ্বজ্ঞা)। ঐ বালকগণ জান্নাতীদেরকে বাসন-কোসন, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি পরিবেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে এবং তারা পুরুষ ও মহিলা উভয় ধরনের জান্নাতীদের নিকট অবাধে যাতায়াত করবে।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তাদের সেবার জন্য এমন সব বালক ব্যস্ত সমস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে, যারা চিরদিনই বালক থাকবে। তোমরা তাদেরকে দেখলে মনে করবে। এরা যেনো ছড়িয়ে দেয়া মুক্তা।”-(সূরা দাহর ঃ ১৯)
সূরা আল ওয়াকীয়াতে বলা হয়েছেঃ “তাদের মজলিসসমূহে চিরন্তন ছেলেরা প্রবাহমান ঝর্ণার সূরায় ভরা পানপত্র ও হাতলধারী সূরাভান্ড এবং আবখোরা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে।”-(সূরা ওয়াকিয়া ঃ ১৭-১৮)
নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “একজন নিম্নমর্যাদার জান্নাতীদের জন্য ৮০ হাজার খাদেম এবং ৭২ জন স্ত্রী থাকবে।”-(তিরমিযি)
১৩. জন্নাতীদের দৈহিক গঠন
রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেনঃ “অল্প বয়সে অথবা বেশী বয়সে যে কোন বয়সেই মারা যাক না কেন যদি তারা জান্নাতী হয় তবে তাদেরকে জান্নাতে ত্ৰিশ (৩০) বৎসরের যুবক বানিয়ে প্রবেশ করানো হবে। তাদের বয়স ও আকার আকৃতি কখনো হ্রাস বৃদ্ধি হবে না।”-(তিরমিযি) ।
অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ “জান্নাতীগণ লোম ও দাড়ি পোষক বিহীন হবে, তাদের চোখ থাকবে সুরমায়িত। তাদের যৌবন কোনদিনই বিলুপ্ত হবে না এবং তাদের কাপড় চোপড়ও পুরানো হবে না।”-(তিরমিযি, দারেমী)
একবার রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নিকট এক বৃদ্ধ আবেদন করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি দু’আ করে দিন আমি যেনো জান্নাতে যেতে পারি।” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ “ কোন বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। একথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদাতে লাগলেন। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেনঃ বুড়ি শোনো, তুমি যখন জান্নাতে যাবে তখন আর বুড়ি থাকবে না। ষোড়ষী যুবতী হয়েই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ কথা শুনে বৃদ্ধ খুশী হয়ে চলে গেলো।”
১৪. জান্নাতীদের পোশাক পরিচ্ছদ
আল্লাহ রকিবুল আলামীন বলেনঃ “জান্নাতুল আদনে (চিরন্তনী জান্নাত) যারা প্রবেশ করবে তাদেরকে সেখানে স্বর্ণের কংকন ও মনি মুক্তার অলংকারে সজ্জিত করা হবে এবং তাদেরকে রেশমের কাপড় পরানো হবে।” (সূরা ফাতির ঃ ৩৩, সূরা আল হজ্জ ঃ ২৩)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তাদের উপর সুক্ষ্ণ রেশমের সবুজ পোশাক, কিংবা ও মখমলের কাপড় থাকবে। এবং তাদেরকে রৌপ্যের কংকন পরাবো হবে।”-(সূরা দাহর ঃ ২১)
সূরা আল কাহাফে বলা হয়েছেঃ “সেখানে তাদেরকে স্বর্ণের কংকন দ্বারা অলংকৃত করা হবে। তারা সূক্ষ্ণ ও গাঢ় রেশমের সবুজ পোশাক পরিধান করবে এবং উচ্চ আসনের উপর ঢেস লাগিয়ে বসবে। এটা অতি উত্তম কর্মফল ও উচু স্তরের অবস্থান।।” (সূরা কাহাফ ঃ ৩১)
সূরা আয় রাহমানে বলা হয়েছেঃ “তারা সবুজ গালিচা ও সুন্দর সুরঞ্জিত শয্যায় এলায়িতভাবে অবস্থান করবে।”- (সূরা আর রাহমান ঃ ৭৬)
উপরোক্ত আয়াতসমূহের আলোকে বুঝা যায় যে, উক্ত পোশাক এবং অলংকার পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই পরানো হবে অলংকার সাধারণতঃ মহিলাগণই পরে থাকে। কিন্তু পুরুষদেরকে পরানো হবে, কথাটি আমাদের নিকট একটু খটকা লাগে। তবে গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, প্রাচীনকালে এমন কি কুরআন যখন অবতীর্ণ হয়েছে তখন রাজাবাদশাগণ, সমাজপতি ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ হাতে, কানো গলায় পোষাক পরিচ্ছেদে অলংকার ও মুকুট ব্যবহার করতেন। এককালে আমাদের দেশের রাজা-বাদশা ও জমিদারগণ বিভিন্ন প্রকার অলংকার পরতেন। সত্যি কথা বলতে কি, তখন পুরুষদের অলংকারাদি ছিলো কৌলিন্যের প্রতীক। এ কথাটি সূরা যুখরূফের একটি আয়াতেও প্রমাণিত হয়। যখন হযরত মূসা (আঃ) জাকজমকহীন পোষাকে শুধুমাত্র একটি লাঠি হাতে ফিরাউনের দরবারে গেলেন, ফিরাউনকে দাওয়াত দেয়ার জন্য, তখন সে সভাসদকে লক্ষ্য করে বলে উঠলোঃ “এ যদি আসমান জমিনের বাদশাহের নিকট হতে প্রেরিতই হতো তবে তাকে স্বর্ণের কংকন পরিয়ে দেয়া হলো না কেনো? কিংবা ফেরেশতাদের একটা বাহিনীই না হয় তার আর্দলী হয়ে আসতো।“(সূরা যখরুফ ঃ ৫৩)
কোথাও স্বর্ণের কংকন আবার কোথাও রৌপ্যের কংকন পরানোর কথা বলা হয়েছে।
১৫. জান্নাতীদের আসবাব পত্র
“তাদের সম্মুখে রৌপ্য নির্মিত পাত্র ও কাঁচের পেয়ালা আবর্তিত করানো হবে। সে কাঁচ–যা রৌপ্য জাতীয় হবে এবং সেগুলোকে পরিমাণ মতো ভরতি করে রাখা হবে।”-(সূরা দাহর ঃ ১৫-১৬)
“তাদের সামনে সোনার থালা ও পান পাত্র আবর্তিত হবে এবং মন ভুলানা ও চোখ জুড়ানো জিনিসসমূহ সেখানে বর্তমান থাকবে। তাদেরকে বলা হবে এখন তোমরা চিরদিন এখানে থাকবে।”-(সূরা যুখরুফ ঃ ৭১)
এখানেও দেখা যাচ্ছে কোথাও স্বর্ণের এবং কোথাও রৌপ্যের পাত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে স্বর্ণের অথবা রৌপ্যের পান পাত্র একত্রে অথবা পৃথক পৃথক ব্যবহার করা হবে। তবে রৌপ্য পাত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে যে, সে পাত্রগুলো যদিও রৌপ্যের তৈরী হবে। কিন্তু কাচের মতো স্বচ্ছ দেখা যাবে। যা দেখলে কাচের মতোই মনে হবে কিন্তু কাঁচের মতো ভঙ্গুর হবে না। ঠিক তদ্রুপ স্বচ্ছ বালাখানার কথাও হাদীসে উল্লেখ আছে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ
“জান্নাতের মধ্যে এমন বালাখানা আছে (স্বচ্ছতার কারণে) যার ভেতরের অংশ বাইরে থেকে এবং বাইরের অংশ ভেতর থেকে দেখা যায় ।”- (তাবারানী, যাদেরাহ)
“তাদের চিরুনী হবে স্বর্ণের তৈরী … তাদের ধুপদানী সুগন্ধী কাঠ দিয়ে জ্বালানো হবে।”-(বুখারী, মুসলিম)
১৬. জান্নাতের নদী ও ঝর্ণাসমূহ
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ “ঐ সমস্ত ঈমানদারদের জন্য সুসংবাদ । যারা আমলে সালেহ (সৎ কাজ) করবে, তাদের জন্য এমন সব বাগান আছে যার নিম্নদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে।”-(সূরা আল-বাকারা ঃ ২৫)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “নিঃসন্দেহে মুত্তাকীগণ নিরাপদ স্থানে থাকবে এবং সেখানে অনেক বাগান ও ঝর্ণা থাকবে।”-(সূরা দোখান ঃ ৫১-৫২)
সূরা যারয়াতে বলা হয়েছেঃ “অবশ্য, মুত্তাকী লোকেরা সেদিন বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারা সমূহের পরিবেষ্টনে অবস্থান করবে। তাদের রব তাদেরকে যা দেবেন সানন্দে তারা তা গ্ৰহণ করতে থাকবে। (এটা এজন্য যে,) তারা এর আগে মুহসিন (সদাচারী) বান্দা হিসেবে পরিচিত ছিলো।”-(সূরা যারিয়াত ৪ ১৫-১৬)
বাগান সমূহের নিচ দিয়ে প্রবাহের অর্থ হচ্ছে, বাগান সমূহের পাশ দিয়ে নদী নালা প্রবাহমান থাকবে। কেননা বাগ-বাগিচা যদিও নদীর কিনারে হয় তবু তা নদী থেকে একটু উঁচু জায়গাই হয়ে থাকে এবং নদী ও বাগান থেকে সামান্য নিচু দিয়েই প্রবাহিত হয়।
পক্ষান্তরে যে সমস্ত জায়গায় ঝর্ণার কথা বলা হয়েছে সেখানে বুগান এবং ঝর্ণা একত্রে থাকবে একথাই বলা হয়েছে। আমরা জানি বাগানের মধ্যে বা একই সমতলে ঝর্ণা থাকা সম্ভব। শুধু সম্ভবই নয় বাগানের শোভা বর্ধনের একটি অন্যতম উৎসও বটে। তাই কুরআনের ভাষা হচ্ছেঃ সে দিন তারা বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাসমূহের পরিবেষ্টনে অবস্থান করবে।
“জান্নাতের ছায়া তাদের উপর বিস্তৃত হয়ে থাকবে এবং তার ফলসমূহ সর্বদা আয়ত্বের মধ্যে থাকবে।”-(সূরা দাহর ঃ ১৪)
একই জায়গায় নানা ধরনের ফুল ফলের বাগান, বড়ো বড়ো ছায়াদার বৃক্ষরাজি, ঝর্ণাসমূহ, সাথে বিশাল আয়তনের অট্টালিকাসমূহ, পাশ দিয়ে প্রবাহমান নদী, একত্রে এগুলোর সমাবেশ ঘটলে পরিবেশ কতো মোহিনী মনোমুগ্ধকয় হতে পারে তা লিখে বা বর্ণনা করে বুঝানো কোন ক্রমেই সম্ভব নয় শুধুমাত্র মানের চোখে কল্পনার ছবি দেখলে কিছুমাত্র অনুমান করা সম্ভব।
জান্নাতে মোট চার ধরনের নদী প্রবাহিত হবে। যথা- (১) পানি (২) দুধ (৩) মধু ও (৪) শরাব । তাছাড়া তিন ধরনের ঝর্ণা প্রবাহমান থাকবে। (১) “কাফুর” নামক ঝর্ণা। এর পানি সুঘ্ৰাণ এবং সুশীল। (২) সালসাবিল ঝর্ণা। এর পানি ফুটন্ত চা ও কফির ন্যায় সুগন্ধি ও উত্তপ্ত থাকবে। (৩) তাছনীম নামক ঝর্ণা। এর পানি থাকবে নাতিশীতোষ্ণ ।
মহান আল্লাহ বলেনঃ মুত্তাকী লোকদের জন্য যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছিলো তার পরিচয় হচ্ছে, সেখানে স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট পানির নদী প্রবাহমান থাকবে। এমন দুধের নদী প্রবাহিত হবে যা কখনো বিষাদ হবে না। এমন শরাবের নদী প্রবাহিত হবে যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু ও সুপেয় (নেশাহীন) হবে। (তাছাড়া) স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন মধুর নদীও প্রবাহিত হবে।” (সূরা মুহাম্মদ ঃ ১৫)
১৭. জান্নাতের বৃক্ষ ও বিহঙ্গকুল
“জান্নাতের মধ্যে কিছু বৃক্ষ এমন বড়ো ও বিশাল হবে কোন সওয়ারী যদি তার ছায়া অতিক্রম করতে চায়। তবে একশ বছর চলার পরও তা অতিক্রম করতে পারবে না।” (বুখারী ও মুসলিম) অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ “জান্নাতে এমন কোন বৃক্ষ নেই যার শাখা প্রশাখা স্বর্ণের নয়।” (তিরমিযি)
হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি সালমান ফারেন্সীর নিকট গেলাম। তিনি আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে ছোট্ট একটি কাঠের টুকরো নিলেন, যা তার দু’ আঙুলোর মাঝে থাকার কারণে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিলো না। তিনি বললেনঃ যদি তুমি জান্নাতে এতটুকু কাঠ সংগ্ৰহ করতে চাও তা পারবে না। আমি বললামঃ তাহলে খেজুর গাছও অন্যান্য গাছপালা কোথায় যাবে (যে কথা কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ আছে)? তিনি বললেনঃ অবশ্য খেজুর ও • অন্যান্য গাছপালা সেখানে থাকবে। তবে তা কাঠের হবে না। বরং তার শাখা, প্ৰশাখাগুলো মোতি ও স্বর্ণের তৈরী হবে। আর তাতে থাকবে কাঁদি কাঁদি খেজুর।-(বাইহাকী)
জান্নাতে শুধু গাছ-পালা, নদী-নালা ও ঝর্ণাধারাই থাকবে না। সেখানে রঙ বেরং নানা প্ৰজাতির পাখীও থাকবে। তারা সারাক্ষণ কলা কাকলীতে মুখরিত্র করে রাখবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতে লম্বা ঘাড় বিশিষ্ট উটের ন্যায় পাখীও আছে। যারা সর্বদা জান্নাতের বৃক্ষরাজীর মধ্যে বিচরণ করে বেড়ায়।” হযরত আবু বকর (রাঃ) শোনে আরজ করলেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ! তারাতো খুব আনন্দময় ও সুখকর জীবন যাপনে রত। রাসূল (সাঃ) বললেনঃ “সেগুলোর ভক্ষণকারীরা সেখানে আরো উত্তম জীবন যাপন করবে।” একথা তিনি তিনবার বললেন। -(মুসনাদে আহমদ)
১৮. জান্নাতীদের খাদ্য ও পানীয়
মহান আল্লাহ রাব্ববুল আলামীন বলেনঃ “মুক্তাকী লোকেরা সেখানে বাগানসমূহে ও নিয়ামত সম্ভারের মধ্যে অবস্থান করবে। মজা ও স্বাদ আস্বাদন করতে থাকবে সে সব জিনিসের যা তাদের রব তাদেরকে দেবেন। তারা তাদের রব তাদেরকে জাহান্নামের আজাব হতে রক্ষা করবেন। (তাদেরকে বলা হবে) খাও এবং পান কর মজা ও তৃপ্তির সাথে এটা তো তোমাদের সে সব কাজের প্রতিফল যা তোমরা (পৃথিবীতে) করছিলে।”- (সূরা তুর ঃ ১৭-১৯)
অন্যত্র বলা হয়েছে ঃ “সেখানে তারা বাঞ্ছিত সুখভোগে লিপ্ত থাকবে। (তাদের অবস্থান হবে) জন্নাতের উচ্চতম স্থানে। যার ফলসমূহের গুচ্ছ ঝুলতে থাকবে। (বলা হবে) পাও এবং পান করে, তৃপ্তি সহকারে। সে সব আমলের বিনিময়ে যা তোমরা অতীত দিনে করেছো।”- ( আল হাক্কাহ ঃ ২১-২৪)
আরো বলা হয়েছেঃ “জান্নাতের ফল দেখতে পৃথিবীর ফলের মতোই হবে। যখন কোন ফল তাদের দেয়া হবে খাবার জন্য, তারা বলবেঃ এ ধরনের ফল তো আমরা পৃথিবীতেই খেয়েছি।”-(সূরা বাকারাহ ঃ ২৫)
ফলগুলো যদিও পৃথিবীর মতো হবে কিন্তু স্বাদ ও গন্ধে সম্পূর্ণ উন্নত ও ভিন্ন ধরনের হবে।
প্রতিবার খাওয়ার সময়ই তার স্বাদ গন্ধ বৃদ্ধি পাবে।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, পৃথিবীতে দুঃখ আছে বলেই সুখকে আমরা উপভোগ করতে পারি। কিন্তু জান্নাতে যদি দুঃখ না থাকে তবে শুধু সুখ উপভোগ করা যাবে কি? বা সুখ ভোগ করতে করতে একঘেয়েমী লাগবে না?
এর দুটি উত্তর হতে পারে–
প্রথমতঃ জান্নাতীগণ জাহান্নামীদের অবস্থা অবলোকন করতে পারবে এবং কথপোকথনও হবে। (সূরা আ’রুফ দ্রষ্টব্য) তাই তাদের সুখকে জাহান্নামীদের সাথে তুলনা করতে কষ্ট হবে না এবং সে সুখে এক ঘেয়েমিও আসবে না।
দ্বিতীয়তঃ দুঃখ না থাকলেও সুখের মাত্রা স্থিতিশীল হবে না, পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কাজেই সে সুখভোগে কখনো ক্লান্তি আসবে না বরং সুখভোগের অনুভূতি তীব্র হতে তীব্রতর হবে।
১৯. জান্নাতীদের প্রস্রাব পায়খানার প্রয়োজন হবে না
হযরত জাবির (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন: “জান্নাতীগণ জান্নাতের খাবার খাবে এবং পানীয় বস্তু পান করবে। কিন্তু তাদের পায়খানা প্রস্রাবের প্রয়োজন হবে না, এমনকি তাদের নাকে ময়লা জমবে না। ঢেকুরের মাধ্যমে তাদের পেটের খাদ্যদ্রব্য হজম হয়ে মিশকের সুগন্ধির মতো বেরিয়ে যাবে। শ্বাস-প্ৰশ্বাস গ্রহণের মতোই তারা তাসবীহ তাকবীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।”-(মুসলিম)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তাদেরকে পেশাব পায়খানা করতে হবে না, মুখে থুথু আসবে না, আর নাকে কোনরূপ ময়লা জমবে না।”- (বুখারী, মুসলিম)
২০. জান্নাতীদের সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ “যে দলটি সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো সুন্দর ও উজ্জ্বল হবে। তাদের পর যারা প্ৰবেশ করবে তাদের চেহারা হবে আকাশের সর্বাধিক আলোক উজ্জ্বল তারকার মতো জ্যোতিময়। আর সকলের অন্তকরণ একটি অন্তকরণ সাদৃশ হবে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ বা বৈপরিত্য থাকবে না।-(বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহ রাব্ববুল আলামীন ইরশাদ করেছেনঃ “আমি তাদের অন্তর থেকে ঈর্ষা ও বৈরিতা দূর করে দেবো। তারা ভাইয়ের মতো পরস্পর মখোমুখি হয়ে আসন সমূহে সমাসীন থাকবে।”
২১. জান্নাতীগণ জান্নাতী বাপদাদা, স্ত্রী ও সন্তানসহ একান্নাবতী পরিবারের ন্যায় বসবাস করবে
মহান আল্লাহ বলেনঃ “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তান ও ঈমানের কোন মাত্রায় তাদের পদাংক অনুসরণ করেছে, তাদের সে সন্তানদেরকে আমরা (জান্নাতে) তাদের সাথে একত্রিত করবো, আর তাদের আমলে কোন রকম কম করা হবে না।”-(সূরা তুর ঃ ২১)
“তারাতো চিরন্তন জান্নাতে প্রবেশ করবেই, তাদের সাথে তাদের বাপদাদা,তাদের স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে যারা সৎ ও নেককার তারাও তাদের সাথে সেখানে (জান্নাতে) যাবে। ফেরেশতাগণ চারদিক হতে তাদের সম্বর্ধনা দিতে আসবে এবং বলবে তোমাদের প্রতি শান্তি।”-(সূরা রা’দ ঃ ২৩)
এখানে উল্লেখ্য যে, যে সমস্ত সস্তান অপ্রাপ্ত বয়সে মৃত্যুবরণ করে তাদের কপা বলা হয়নি, কেননা তাদের ব্যাপারে তো কুফার, ঈমান, আল্লাহর আনুগত্য ও নাফরমানীর প্রশ্নই উঠে না। সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, তারা এমনিই জান্নাতে যাবে এবং মা বাপের সম্ভাষ্টির জন্য তাদের সাথে একত্রিত করে দেয়া হবে।
২২. জান্নাতের বাজার
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ “জান্নাতে একটি বাজার আছে। সেখানে জান্নাতীগণ প্রতি শুক্রবার যাবে। সেখানে উত্তর দিক হতে মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হয়ে জান্নাতিদের মুখমন্ডল ও পরিধেয় বস্ত্ৰাদি সুগন্ধিতে ভরিয়ে দেড়বে। আর তাদের সৌন্দর্য ও রূপ লাবণ্য পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকবে। সুতরাং তারা অত্যন্ত সুন্দর ও লাবণ্যময় হয়ে নিজেদের স্ত্রীর নিকট ফিরে আসবে। স্ত্রীগণ তাদেরকে দেখে বলবে, আল্লাহ শপথ! তোমরা যে সৌন্দৰ্য্য ও লাবান্যের অধিকারী হয়েছে। আবার পুরুষগণও বলবে, আল্লাহর কসম!! আমরা তোমাদের কাছ হতে যাবার পর তোমাদের রূপলাবণ্য এবং সৌন্দর্যও অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।”-(মুসলিম)
হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। রাসূলে পাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ জান্নাতে একটি বাজার আছে, কিন্তু সেখানে কোন বেচা কেনা হয় না। সেখানে অসংখ্য পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের প্রতিকৃতি ও ছবি থাকবে। কোন ছবি দেখে যদি কেউ আকাংখা করে যে আমার চেহারাটা যদি এর মতো হতো তখন তাদের সাথে সাথে তার সে আকৃতি ও কাংখিত রূপ নেবে।– (তিরমিযি)
২৩. জান্নাতীদের মর্যাদাভেদে জান্নাতের প্রকারভেদ
পবিত্ৰ কালামে জান্নাতীদেরকে দু’ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ ১) ডান বাহুর লোক (২) অগ্রবর্তী লোক।
ইরশাদ হচ্ছে ঃ “অতঃপর ডানবাহুর লোক। ডানবাহুর লোকের (সৌভাগ্যের কথা) কি বলা যায়?”-(সূরা ওয়ােকীয়া ৪৮) –
“আর অগ্রবর্তী লোকেরা তো (সকল ব্যাপারে)। অগ্রবর্তীই। তারাই তো সান্নিধ্যশালী লোক।”- (সূরা ওয়াকীয়া ঃ ১০-১১)
রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতীরা তাদের উপরতলার লোকদেরকে এমনভাবে দেখতে পাবে, যেমন করে তোমরা পূর্ব অথবা পশ্চিম দিগন্তে উজ্জ্বল তারকাগুলো দেখতে পাও ৷ তাদের পরস্পর মর্যাদার পার্থক্যের কারণে এরূপ হবে” সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন “ইয়া রাসূলুল্লাহ। ঐ স্তরগুলো কি নবীদের যা অন্য কেউ লাভ করতে পারবে না? তিনি বললেনঃ “কেন পারবে না! সেই সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ। যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং নবীদেরকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারা ঐ স্তরে যেতে সক্ষম হবে।” (বুখারী, মুসলিম)
অত্র হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, জান্নাতীদের আমলের তারতম্যের কারণে সেখানে তাদের মর্যাদাও বিভিন্ন রকম হবে। অনেক হাদীসে জান্নাতীদের নেয়ামতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে নিম্নমানের এক জান্নাতীকে অমুক অমুক বস্তু দেয়া হবে। তে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে জানুয়াতীদেরকে আল্লাহ তাদের আমল ও মর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন মানের জামাত দেবেন। নিম্নোক্ত হাদীস দু’টো এ কথারই প্রমাণ করে।
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “সবচেয়ে নিম্নমানের একজন জান্নাতী ৮০ হাজার খাদেম, ৭২ জন স্ত্রী পাবে এবং ঐ সমস্ত স্ত্রীগণ যে সমস্ত ওড়না ব্যবহার করবে তার মধ্যে জামরুদ, মুক্তা ও ইয়াকুতের কারুকার্য খচিত হবে।”- (তিরমিযি, মিশকাত, ইবনে মাজাহ্)
নবী করীম (সাঃ) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন- “আমি আমার নেক (সালেহ) বান্দাদের জন্য যা কিছু রেখেছি তা কোন চােখ দেখেনি, কোন কান তা (বিবরণ) শুনেনি, কোন হৃদয়ও তা কল্পনা করতে পারেনি।”- (হাদীসে কুদসী-বুখারী, মুসলিম)
এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় কুরআন ও হাদীসে জান্নাতের যে আলোচনা করা হয়েছে তা সাধারণভাবে সকল জান্নাতীদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রিয় ও সালেহ বান্দাহ তাদেরকে এর অতিরিক্ত আরও কিছু দেবেন। তার বর্ণনা আল্লাহ কোথাও করেননি। শুধু এ ইঙ্গিতটুকু দেয়াই যথেষ্ট মনে করেছেন।
২৪. নিম্ন মর্যাদার জান্নাতীদের প্রাপ্য
‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ মুসা (আঃ) তাঁর প্রভুকে জিজ্ঞেস করলেন: “সবচেয়ে কম মর্যাদার জান্নাতী কে? আল্লাহ বললেন, সে ঐ ব্যক্তি যে জান্নাতীদেরকে জান্নাত বন্টনের পর আসবে। তাকে বলা হবে জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলবেঃ হে প্ৰভু! সব লোক নিজ নিজ বাসস্থানে অবস্থান নিয়েছে এবং নিজেদের প্রাপ্য অংশ গ্রহণ করেছে, তাই আমি এখন কিভাবে জান্নাতে স্থান পাবো? তাকে বলা হবে তোমাকে যদি পৃথিবীর কোন বাদশাহ বা শাসকের রাজ্যের সমান এলাকা দেয়া হয়, তবে কি তুমি খুশি হবে? তখন সে বলবে, প্ৰভু আমি রাজী আছি। আল্লাহ তাআলা তাকে বললেনঃ তোমাকে তাই দেয়া হলো । এরপরও তার সমান আরও দেয়া হলো । এরপর তার সমান আরো এবং এরপর এগুলোর সমান আরও অতিরিক্ত দেয়া হলো । পঞ্চমবারে সে বলবে, প্ৰভু! আমি সন্তুষ্ট হলাম। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, – তোমাকে সবগুলোর সমান আরও দশগুণ দেয়া হলো। সে বলবে, হে প্ৰভু আমি খুশী হয়েছি।”- (মুসলিম) –
রাসূলের আকরাম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেনঃ এক ব্যক্তি নিতম্বের উপর ভর দিয়ে হেচড়াতে হেচড়াতে জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসবে। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে বলবেনঃ যাও, জান্নাতে প্ৰবেশ করো। সে জান্নাতের কাছে গেলে তার মনে হবে ইতিমধ্যেই জান্নাত পরিপূর্ণ করো। সে আবার এসে বলবে, হে প্ৰভু! আমি দেখলাম জান্নাত ভরপুর হয়ে গিয়েছে। তখন সে মহান আল্লাহর কথায় আবার যাবে এবং ফিরে এসে আগের মতোই বলবে। পরিশেষে মহান আল্লাহ বলবেনঃ তুমি জান্নাতে যাও। কেননা তোমার জন্য পৃথিবীর সমপরিমাণ এবং অনুরূপ আরো দশগুণ অথবা পৃথিবীর মতো দশগুণ জায়গা নির্মিত হয়েছে। তখন লোকটি বলবেঃ হে আল্লাহ। আপনিও কি আমাকে বিদ্রুপ করেছেন? অথচ আপনি সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ আমি দেখলাম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একথা বলে এমনভাবে হাসলেন যে তাঁর পবিত্র দাঁত দেখা যাচ্ছিল। তিনি বলছিলেনঃ এ ব্যক্তি হবে সবচেয়ে নিম্ন মর্যাদার জান্নাতী ।-(বুখারী, মুসলিম)
আ’তা ইবনে ইয়ামীদ লাইসী থেকে বর্ণিত। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে অবহিত করেছেন যে, মহান আল্লাহ যখন বান্দাহদের বিচার * ফায়সালা সমাপ্ত করবেন এবং নিজের রহমত ও অনুগ্রহে কিছুসংখ্যক লোককে দোযখ থেকে মুক্ত করার ইচ্ছা করবেন। এদের মধ্যে যারা আল্লাহর । সাথে কোন কিছুকে শরীক করেনি তাদেরকে দোযখ থেকে বের করার জন্যে তিনি ফেরেশতাদের আদেশ করবেন। আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে এভাবে অনুগ্রহ করবেন। এরা হচ্ছে এমন লোক, যারা এ সাক্ষ্য প্ৰদান করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। ফেরেশতারা দোযখের মধ্যে তাদেরকে চিনতে পারবেন। তাঁরা তাদেরকে সিজদার চিন্তু বা স্থান ব্যতীত এসব বনী আদমের দেহের সবকিছুই দোযখের আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। বস্তুত আল্লাহ তা’আলা সিজদার চিহ্নসমূহ আগুনের ওপর হারাম করে দিয়েছেন। অতএব তারা অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় কালো কয়লার মতো হয়ে দোযখ থেকে বের হবে। অতপর তাদের দেহের ওপর আবে হায়াত’ (জীবনদানকারী পানি) ঢালা হবে। এখান থেকে তারা এমনভাবে সজীব হয়ে উঠবে, যেমন বীজ ভেজা মাটিতে আপনা। আপনি অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে ওঠে। এরপর আল্লাহ তা’আলা বান্দাহদের বিচার ফায়সালা শেষ করবেন। এরপর একটিমাত্র লোক অবশিষ্ট থাকবে। তার মুখ দোযখের দিকে ফেরানো থাকবে। সে হবে সবশেষে জান্নতি লাভকারী। সে বলবে, হে আমার প্রভু, দোযখের দিক থেকে আমার মুখটি ফিরিয়ে দিন। দোযখের দুৰ্গন্ধ আমাকে অসহ্য কষ্ট দিচ্ছে এবং এর অগ্নিশিখা আমাকে একেবারে দগ্ধ করে ফেলেছে। সে এ অবস্থায় আল্লাহ তা’আলার মার্জিমাফিক তাঁর কাছে দোয়া করতে থাকবে। তখন আল্লাহ তাকে বলবেন ঃ তুমি যা চাও তা যদি ৷ তোমাকে দিই, তাহলে আরো কিছু চাইবে কি? সে বলবে, না। আমি এছাড়া আর কিছুই তোমার কাছে চাইবোনা। সে তার মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তা’আলাকে তাঁর ইচ্ছানুসারে এ মর্মে আরো অনেক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি দিতে থাকবে। তখন আল্লাহ তা’আলা তার মুখ দােযখের দিক থেকে ফিরিয়ে দেবেন। যখন সে বেহেশতের দিকে মুখ করবে এবং বেহেশত দেখবে তখন আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী কিছুক্ষণ নীরব থাকবে। অতপর বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে জান্নাতের দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন। তার কথা শুনে আল্লাহ বলবেন ঃ তুমি কি ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি দাওনি যে, তোমাকে যা দেয়া হবে, তাছাড়া আর কিছুই চাইবেনা? আফসোস হে আদম সস্তানা তুমি কি সাংঘাতিক ওয়াদা ভঙ্গকারী, বড়ই অকৃতজ্ঞ। সে আবার “হে আমার প্রভু” বলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলাকে ডাকতে থাকবে। অবশেষে আল্লাহ তাকে বলবেন ঃ এটা যদি তোমাকে দেয়া হয়, তাহলে তুমি পুনরায় আর কিছু চাইবে কি? সে বলবে, তোমার ইজতের কসম, এছাড়া আমি আর কিছুই চাইবোনা। তারপর সে এ মর্মে আল্লাহ তা’আলাকে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকবে এবং আল্লাহও তাকে জান্নাতের দুরজার কাছে এগিয়ে দেবেন। যখন সে জান্নাতের দরজায় দাঁড়াবে, তখন তার দরজা খুলে যাবে এবং সে তার মধ্যকার আরাম-আয়েশ ও আনন্দের প্রাচুর্য দেখতে পাবে, আর আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন, সে ততক্ষণ নীরব নিশ্চুপ থাকবে। তারপর বলবে, হে আমার রব, আমাকে জান্নাত দান করো। আল্লাহ বলবেন ঃ তুমি কি এ মর্মে ওয়াদা ও প্ৰতিশ্রুতি দাওনি যে, আমি যা দেবো তা ব্যতীত অন্য আর কিছুই চাইবেনা? আফসোস হে আদম সস্তান, তুমি বড়ই ধোকাবালে। সে বলবে, হে আমার প্রভু, আমি তোমার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে দুৰ্ভগা হতে চাইনা। সে – আবার আল্লাহকে ডাকতে থাকবে। তার অবস্থা দেখে আল্লাহ হাসবেন। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ যখন হাসবেন, তখন বলবেন ঃ যাও ঠিক আছে ‘জান্নাতে প্ৰবেশ করো। সে জান্নাতে প্ৰবেশ করলে, আল্লাহ তাকে বলবেন ঃ এবার আমার কাছে চাও। সে তার রবের কাছে চাইবে ও আকাংখা প্ৰকাশ করবে। এমনকি আল্লাহ তা’আলা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবেন ঃ এটা ওটা চাও। যখন তার আকাংখা শেষ হয়ে যাবে, তখন আল্লাহ বলবেন ঃএসবই তোমাকে দেয়া হলো এবং তার সাথে অনুরূপ আরো দেয়া হলো। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ঐ লোকটি জান্নাতে প্ৰবেশকারী
সর্বশেষ ব্যক্তি। -(মুসলিম)
২৫. জান্নাতীগণ আল্লাহর দর্শন লাভ করবে
আল্লাহ্র দর্শনের ব্যাপারে আল-কুরআনের মাত্র দু’জায়গায় আলোচনা করা হয়েছে। সূরা আল কিয়ামাহ এবং সূরা আল মুতাফফিফীনে ইরশাদ হচ্ছেঃ
“সেদিন কিছু সংখ্যক মুখমন্ডল উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত হবে এবং নিজের । রবের দিকে তাকাতে থাকবে।”-(সূরা কিয়ামাহ ঃ ২২-২৩)
“নিঃসন্দেহে সেদিন এ লোকদেরকে তাদের রব এর দর্শন হতে বঞ্চিত রাখা হবে।”-(সূরা মুতাফফীন ঃ ১৫)
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহর কসম, জান্নাতীদের জন্য আল্লাহর দর্শন ব্যতিরেকে অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় আর কিছু হবে না।–(তিরমিযি)
২৬. চিরদিনের জান্নাত চিরদিনের জাহান্নাম
পৃথিবীতে যতোগুলো বাস্তব ও চাক্ষুষ বস্তু আছে তার মধ্যে মৃত্যু একটি। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ পার্থিব কোন বস্তু থেকেই অমনোযোগী ও গাফেল নয় একমাত্র মৃত্যু ছাড়া। যদিও আমাদের প্রত্যেককেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। তবুও মৃত্যুকে আমরা ভীতির চোখে দেখি এবং মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াবার ব্যর্থ প্রয়াস পাই। এ ভীতিকর অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র গ্যারান্টি থাকবে জান্নাতীদের জন্য। মহান আল্লাহ বলেনঃ “সেখানে তারা আর কখনো মৃত্যুর মুখোমুখি হবে না। পৃথিবীতে একবার যে মৃত্যু হয়েছে সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি হতে বঁচিয়ে দেবেন।”-( দোখান ঃ ৫৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহান আল্লাহ যখন জান্নাতবাসীদের জান্নাতে এবং জাহান্নামবাসীদের জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দেবেন, তখন মৃত্যুকে আনা হবে এবং জান্নাত এ জাহান্নামবাসীদের মাঝখানে অবস্থিত দেয়ালের উপর রাখা হবে। তখন জান্নাতবাসীদের ডাকা হবেঃ “হে জান্নাতবাসী!” ডাক শুনে তারা ভয়ে ভয়ে উপস্থিত হবে। অতপর জাহান্নামবাসীদের ডাকা হবেঃ “হে জাহান্নামবাসী।’ ডাককে তারা সুসংবাদ ভেবে হাজির হবে। তারা-শাফায়াতের আশা করবে। অতপর জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের বলা হবেঃ তোমরা কি একে (মৃত্যুকে) চিনো? তারা উভয় দিকের লোকেরাই বলবেঃ আমরা চিনতে পেরেছি। এ হলো সেই মৃত্যু, যাকে আমাদের উপর নিযুক্ত করা হয়েছিল। অতপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দেয়া হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী দেয়ালের উপর চিরতরে জবাই করে দেয়া হবে । এরপর ডেকে বলা হবেঃ হে জান্নাতবাসী! চিরদিন জায়াতে থাকো, আর মৃত্যু হবেনা। হে জাহান্নামবাসী! চিরদিন জাহান্নামে থাকো, আর মৃত্যু হবেনা। (বুখারী, মুসলিম)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ জান্নাতবাসীদের বলবেন, হে জান্নাত বাসীগণ!” তারা বলবে হেতু আমাদের প্রভু, আমরা উপস্থিত। সমস্ত মঙ্গল ও কল্যাণ। আপনার হাতে। (কি আদেশ বলুন) আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে । জিজ্ঞাসা করবেন, তোমরা কি তোমাদের আমলের প্রতিদান পেয়ে সস্তুষ্ট হয়েছে? তারা (জান্নাতীগণ) জবাব দিবে- হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন সব নেয়ামত দিয়েছেন যা অন্য কাউকে দেননি। তখন আমরা সন্তুষ্ট হবো না কেনো? তখন আল্লাহ বলবেন আমি তোমাদেরকে এর চেয়েও অধিক উত্তম উন্নত জিনিস দান করবো না? তারা বলবে এর চেয়ে । অধিক ও উত্তম বস্তু আর কি হতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেন আমি চিরকাল তোমাদের উপর সম্ভষ্ট থাকবো। কোনদিন আর অসন্তুষ্ট হবো না । (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, –তারাগীব তারহীব, যাদেরাহ)
২৭. “অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না”
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে – যখন দোযখীরা দোযখে একত্রিত হবে এবং তাদের সাথে আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা অনুযায়ী কিছুসংখ্যক মুসলমানও থাকবে, তখন কাফেররা মুসলমানদেরকে প্রশ্ন করবে–তোমরা কি দুনিয়াতে মুসলমান ছিলে না? তারা জওয়াব দিবে, হাঁ ছিলাম। কাফেররা বলবে, তাহলে তোমাদের ইসলাম তোমাদের জন্যে উপকারী হল না কেন? আজ তোমরা ওতো আমাদের সাথে দোযখে রয়েছ। মুসলমানরা বলবে-আমরা অনেক গোনাহ করেছিলাম, তাই সাজাপ্রাপ্ত হয়েছি। আল্লাহ তা’আলা তাদের এই কথাবার্তা শুনবেন এবং আদেশ করবেন, দোযখে যে সকল মুসলমান রয়েছে, তাদের সকলকে বের করে দাও ! অতঃপর আদেশ অনুযায়ী তাদেরকে বের করে আনা হবে। এটা দেখে কাফেররা বলবো–হায়, আমরাও মুসলমান হলে এমনিভাবে মুক্তি পেতাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই আয়াত পাঠ করলেনঃ প্রায়ই কাফেররা বাসনা করবে, যদি তারা মুসলমান হত।
এদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এরশাদ করেছেন ঃ , “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে যেমনভাবে ভয় করা দরকার ঠিক তেমন ভাবে ভয় করো। আর তোমরা অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (আলে ইমরান ঃ ১০২)
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করার পর জিব্রালকে জান্নাতের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে বললেনঃ যাও, জান্নাত এবং তার অধিবাসীদের জন্যে তাতে আমি যেসব নিআমত তৈরী করে রেখেছি, দেখে এসো। নির্দেশমতো তিনি গিয়ে জান্নাত দেখলেন আর দেখলেন সেইসব নিআমতরাজি যা তিনি জান্নাতবাসীদের জন্যে তৈরী করে রেখেছেন। অতপর তিনি আল্লাহর নিকট ফিরে এসে আরয করলেনঃ হে আল্লাহ! তোমার ইযযতের কসম! এমন জান্নাতের সংবাদ যেই শুনবে, সে তাতে প্রবেশ না করে থাকবে না। অতপর আল্লাহর নির্দেশে দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসীবত দ্বারা জান্নাতকে পরিবেষ্টিত করে দেয়া হলো। এবার আল্লাহ বললেনঃ হে জিব্রীল! পুনরায় গিয়ে জান্নাত দেখে এসো আর দেখে এসো সেসব নিআমত যা তার বাসিন্দাদের জন্যে আমি তৈরি করে রেখেছি। জিব্রীল পুনরায় এলেন জান্নাতে। এসেই দেখলেন দুঃখ কষ্ট আর মহাবিপদ মুসীবত দ্বারা জান্নাত পরিবেষ্টিত হয়ে আছে। তিনি ফিরে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ! তোমার ইযযতের কসম! অ, আমার আশংকা হচ্ছে, কোনো লোকই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। অতপর আল্লাহ বললেনঃ এবার গিয়ে জাহান্নামের (ভয়ংকর) দৃশ্য অবলোকন করলেন এবং ফিরে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ! তোমার ইযযতের কসম! যে-ই এ (ভয়ংকর) জাহান্নামের সংবাদ শুনবে সে কখনো তাতে প্ৰবেশ করতে প্ৰস্তুত হবেনা।” অতপর আব্দুল্লাহর নির্দেশে কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা দ্বারা জাহান্নামকে পরিবেষ্টিত করে দেয়া হলো। এবার আল্লাহ বললেনঃ হে জিব্রীল! পুনরায় গিয়ে জাহান্নাম পরিদর্শন করে এসো। নির্দেশমতো তিনি গেলেন এবং সেখান থেকে ফিরে – এসে আরয করলেনঃ তোমার ইযযতের কসম খেয়ে বলছি, হে আল্লাহ! আমার আশংকা হচ্ছে সকল মানুষই জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং কেউই তা থেকে রক্ষা পাবেনা। (তিরমিযি, আবু দাউদ)
উক্ত হাদীস থেকে জানতে পারলাম জান্নাতে যাবার পথ এত সহজতম হবে না মোটেও। আল্লাহ রাব্ববুল আলামীন সাবধান করে বলেছেন, “আলিফ-লাম-মীম। মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, “আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিলেন। আল্লাহু অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথু্যকদেরকে।” (আনকাবুত ঃ ১-৩)
তোমরা কি মনে করেছে, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্ৰবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি। তাদের ওপর। নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসীবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা: হয়েছিল। এমনকি সমকালীন রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে” উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তখন তাদেরকে এই বলে সান্থনা দেয়া হয়েছিল, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। (আলাবাকারা ঃ ২১৪)
তোমরা কি মনে করে রেখেছ তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্ৰবেশ করবে? অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনি, তোমাদের কে তাঁর পথে প্ৰাণ পণ যুদ্ধ করতে প্ৰস্তুত এবং কে তার জন্য সবরকারী (আলে ইমরান ঃ ১৪২)
দুনিয়াতে কুফরীর পথ অবলম্বনকারীর জন্য এরশাদ হচ্ছেঃ
নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, যারা কুফারী অবলম্বন করেছে এবং কুফরীর অবস্থায় জীবন দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি নিজেকে শাস্তি থেকে বাঁচাবার জন্য সারা পৃথিবীটাকে স্বর্ণে পরিপূর্ণ করে বিনিময় স্বরূপ পেশ করে তাহলেও তা গ্ৰহণ করা হবে না। এ ধরনের লোকদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এবং তারা নিজেদের জন্য কোন সাহায্যকারীও পাবে না। (আলে ইমরান ঃ ৯৭)
আর যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে মুশরেক অবস্থায় মারা যাবে। তাদের সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছেঃ বস্তুত আল্লাহ্র সহিত অন্য কাহাকেও যে শরীক করেছে আল্লাহ্ তাহার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়াছেন। আর তাহার পরিণতি হইবে জাহান্নাম। এই সব যালেমদের কেহই সাহায্যকারী নাই।” (আল মায়েদা : ৭২)
আর যারা ভুল করে অনুতপ্ত হয় তাদের সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছেঃ “আর-যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গোনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আবার সংগে সংগে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহখাতার জন্য মাফ চায়–কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন- এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না, এ ধরনের লোকদের যে প্রতিদান তাদের রবের কাছে আছে তা হচ্ছে এই যে, তিনি তাদের মাফ করে দেবেন। এবং এমন বাগীচায় তাদের প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (আলে ইমরান ঃ ১৩৫,১৩৬)
হে নবী! দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আল্লাহর নাফরমান লোকদের চলাফেরা যেন তোমাকে ধোঁকায় ফেলে না দেয়। এটা নিছক কয়েক দিনের জীবনের সামান্য আনন্দ ফুর্তি মাত্র। তারপর এরা সবাই জাহান্নামে চলে যাবে, যা সবচেয়ে খারাপ স্থান। বিপরীত পক্ষে যারা নিজেদের রবকে ভয় করে জীবন ; যাপন করে তাদের জন্য এমন সব বাগান রয়েছে, যার নীচে দিয়ে ঝরণাধারা বয়ে চলছে। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। এ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য মেহমানাদারীর সরঞ্জাম। আর যা কিছু আল্লাহর কাছে আছে, নেক লোকদের জন্য তাই ভালো। (আলে ইমরান ঃ ১৯৭,১৯৮)
তবে একথা ঠিক দুনিয়ার প্রতারণায় পরে যে সকল ব্যক্তিবর্গ জান্নাত নামক আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্ছিত হবে তাদেরচেয়ে হতভাগা আর কেউ হতে পারে না। জাহান্নামকে যেমন ভয় করতে হবে তেমনি জান্নাতেরও আশা করতে হবে। এ ব্যাপারে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, একজন লোকও যদি জাহান্নামে যায়। তবে আমি ভয় করি সেটা আমি না হই এবং একজন লোকও যদি জান্নাতে যায়। তবে আমি আশা করি সেটা যেন আমি হই।
আল্লাহ আমাদেরকে মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার এবং জান্নাতে প্ৰবেশ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
Leave a Reply